আমিরুল ইসলাম রাঙাঃ ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিন পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হতে যাচ্ছেন সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। গোটা জাতি সমগ্র বিশ্ব নিশ্চিত হয়ে আছেন, পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের উপরই ন্যস্ত হতে যাচ্ছে। ডিসেম্বর শেষ হলো, জানুয়ারী শেষ হলো, ফেব্রুয়ারী শেষ হয়ে যাচ্ছে তবুও সামরিক সরকার ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করছে না। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিন। ৩রা মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশন ডাকার কথা । ১লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিবেন। সবাই নিশ্চিত ছিলেন, ঐদিনই হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন ধার্য্য করা হবে। গোটা বাঙালী জাতি অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। রেডিও সামনে ছোট বড় সবাই বসে আছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষনা শোনার জন্য। তেমন একটি মুহুর্তের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, তখন রেডিও হলো একমাত্র সংবাদ জানার মাধ্যেম। পাবনা শহরে তখন হাতে গোনা কয়েকটি টেলিভিশন। রেডিও সেটাও ছিল অপ্রতুল। পাড়া-মহল্লায় দুই চারটা রেডিও ছিল । গ্রাম এলাকায় চেয়ারম্যান-মেম্বার বা গ্রামের সচ্ছল পরিবার ছাড়া কারো রেডিও ছিলো না। ১লা মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিতে বসলেন । তাঁর ভাষণ শুরু করে শেষ হতে যাচ্ছে তবুও ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন কথা বলছেন না । শেষ মুহূর্তে উনি ঘোষণা করলেন, জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। বলা যায় তখন বিনামেঘে বজ্রপাত সংঘটিত হলো। গোটা দেশে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠলো। চারিদিকে তখন জয় বাংলা আর জয় বাংলার গগনবিদারী শ্লোগান। ক্ষোভে-বিক্ষোভে গোটা দেশের মানুষ ফেটে পড়লো। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – সর্বত্র তখন জয় বাংলা আর জয় বাংলা। ২রা মার্চ থেকে শুরু হলো হরতাল। অনিদিষ্ঠকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হলো। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসু’র ভিপি আ স ম আব্দুর রব মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন। ( যে পতাকা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ব্যবহার করা হয়েছে।) ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা ঘোষনা করে, আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ) কে জাতীয় সংগীত করে স্বাধীন বাংলাদেশ এর রুপরেখা ঘোষনা করা হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মূলতঃ তখন থেকে শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১লা থেকে ৭ই মার্চ গোটা পূর্ব বাংলা তখন বাঙালীর বাংলাদেশ। আমি কে তুমি কে – বাঙালী বাঙালী। আমার তোমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা। ঢাকা না পিন্ডি – ঢাকা ঢাকা। আমার দেশ তোমার দেশ – বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র ছাত্র-যুবক, তরুন-তরুনী তখন ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। প্রতিদিন মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত গোটা দেশ। পাড়া মহল্লায় তরুন যুবকদের সংগঠিত করা হচ্ছে – মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। শত্রুদের পথরোধের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় তরুন যুবকদের সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমাদের এলাকার মত গোটা দেশে তখন একই চিত্র। আমার নিজ এলাকা পাবনার রাধানগর তখন রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ন স্থান। এডওয়ার্ড কলেজ তখন ছাত্র রাজনীতির প্রধান কেন্দ্রস্থল । তৎকালীন সময়ে আমাদের এলাকায় ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধীদের শক্ত ঘাটি। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ হলো ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। তাদের মুলদল দল ন্যাপ (ভাসানী) হলেও পাবনায় তখন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে মুলদল থেকে বিছিন্ন হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদারের অনুসারী হয়ে নক্সালপন্থী হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তারা পাবনায় শ্রেনী শত্রু খতমের নামে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে দেয়। তাঁরা শ্রেনী শত্রু বিরোধী রাজনীতি করার কথা বললেও মুলতঃ তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে। তারা ১৯৭০ সালের ২২শে ডিসেম্বর পাবনা শহরের দক্ষিণ রাঘবপুর মহল্লায় নব-নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এমপিএ) আহমেদ রফিককে ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই হীরা লালকে হত্যা করে তার খন্ডিত মাথা বানী সিনেমা হলের সামনে রেখে দেয়। ২৫ মার্চ রাধানগরের প্রধান নক্সাল নেতা মাসুদের বাড়ীতে কৃষ্ণপুরের শুকুর আলীকে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস পাবনার এই নক্সালরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করেছিল। তৎকালীন সময়ে রাধানগর ও পৈলানপুর এলাকায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু, মোখলেছুর রহমান মুকুল, সাঈদ আকতার ডিডু, মিজানুর রহমান তরুণ সহ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দের বাড়ী। মুক্তিযুদ্ধে যারা শীর্ষ পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এছাড়া এলাকা ভিত্তিক আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন, মক্তব পাড়ার আব্দুল মান্নান গোরা ( মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার)। আওয়ামী লীগ নেতা রমজান আলী,মোহররম আলী(শহীদ মুক্তিযোদ্ধা), সোলেমান দোকানদার ( মুক্তিযুদ্ধের সময় নক্সাল বাহিনীর হাতে নিহত), কামরুল ইসলাম ফুটু ( মুক্তিযোদ্ধা) , আব্দুল কাদের, ওহিদুর রহমান প্রমুখ। পৈলানপুর এলাকায় ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান মাহবুবুল হক (ফেরু দেওয়ান), আবুল কাশেম উজ্জ্বল ( মুক্তিযোদ্ধা) আব্দুল লতিফ সেলিম ( মুক্তিযোদ্ধা) আব্দুল্লাহ হিল কাফি( মুক্তিযোদ্ধা), শফিকুর রহমান শফি ( মুক্তিযোদ্ধা), দেওয়ান মাহমুদুল হক দুলাল( মুক্তিযোদ্ধা) সহ আরো অনেকে।এবার আমার দেখা ৭ই মার্চ নিয়ে বলার আগে প্রসঙ্গগত বলতে হয় যে,আমি ১৯৬৭ সালের শুরু থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হই। পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমী ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ও পরবর্তীকালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। ১৯৬৯ সালে গন-আন্দোলনের সময় গঠিত স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাবনা জেলা কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক ছিলাম। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলাম। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর পাবনায় আগমন, টাউন হলের জনসভায় অবস্থান, ৬৭ সালে পাবনায় ভুট্টা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ সহ ১৯৬৮ এবং ৬৯ সালে গন-আন্দোলনে মিছিল মিটিংয়ে সক্রিয় উপস্থিত থাকতাম। ১৯৬৯ ও ৭০ সালে ঢাকায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছি । ১৯৭০ সালে পাবনায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়ে আমার লেখা কবিতা শুনিয়েছি। ১৯৭০ এর ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী প্রচারনা সহ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার চেষ্টা করেছি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিবেন। সমস্ত মানুষের উৎকন্ঠা। কি হবে, কি করবেন, কি বলবেন, সেই নিয়ে কানা-ঘুষা। কেউ বলছেন বঙ্গবন্ধু ঐদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। কেউ বলছেন, বঙ্গবন্ধু ঐদিন স্বাধীনতার ঘোষনা দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিমান থেকে বোমা-বর্ষন করবেন। কেউ বলছেন বঙ্গবন্ধু ঐদিন রেসকোর্স ময়দানে যাবেন না। তাঁকে দলের শীর্ষ নেতারা যেতে দিবেন না। পূর্বেই ঘোষনা করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষন রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সারাদেশের মানুষ রেডিও’র সামনে বসে আছে। আমি সেদিন বাড়ীর সন্নিকটে মক্তব স্কুলের পাশে মোহরম আলীর (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) রিক্সা ও সাইকেল মেরামতের দোকানের সামনে বসে আছি। পাশে সোলেমান দোকানদারের ( নক্সালদের হাতে শহীদ) ওখানে রেডিও আছে । মুরুব্বীরা সোলায়মান দোকানদারের ওখানে আর তরুন-যুবকরা মোহরমের দোকানে বসেছে । দুপুরের আগে থেকে বসে আছি। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ ভাষন হচ্ছে না। আসল ঘটনা হলো, ১লা মার্চ থেকে ৭ই মার্চ পর্যন্ত রেডিও ছিল বাঙালী কর্মচারীদের দখলে। এই কয়দিন ধরে রেডিওতে দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান প্রচার হলেও ৭ই মার্চ দুপুরের আগে রেডিও স্টেশন পাকিস্তান সৈন্যরা দখল করে নেয়। ফলে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনটি আর রেডিওতে প্রচার করা হয়নি। এমতাবস্থায় গোটা দেশের মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । এরপর আমরা মক্তব থেকে মিছিল নিয়ে শহরের যাই। শহরের প্রধান সড়ক আব্দুল হামিদ রোডে হাজার হাজার জনতা। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে আসা ছাত্র জনতার মিছিলে মিছিলে শহর উত্তাল হয়ে উঠেছে। ৮ই মার্চ সকালে জানা গেল বঙ্গবন্ধুর গতকালের ভাষন আজ রেডিওতে প্রচার করা হবে। সাথে সাথে চারদিক থেকে জয় বাংলা – জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো। দৌড়ে মক্তব গিয়ে দেখি মোহরম আলীর দোকানের সামনে শত শত মানুষের ভীড়। শহর থেকে মাইক ভাড়া করে আনা হয়েছে। রেডিও থেকে প্রচারিত ভাষন মাইকের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে শোনানো হবে। সেদিনের সেই অনুভূতির কথা স্মরণ হলে শরীরের সমস্ত লোম এখনও দাড়িয়ে যায়। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর ভাষন। সেই ১৮ মিনিটের ভাষন এখনো কানে বাজে। সেই ভাষনের শেষ লাইন হলো সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর ধ্বনি- এবাবের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শুরু হলো বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষনা করা হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার বীজ বোপন করেছিলেন ১৯৬২ সালে আর তা অঙ্কুরিত হয় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ৭ই মার্চ হলো জাতির জীবনে একটি বিশেষ দিবস। ( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া পাবনা