কবি সুমন শামসের এক গুচ্ছ কবিতা

শেয়ার করুন

  • এইসব বহুবিধ হত্যায়

আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো মাতৃগর্ভ থেকে।

আমি শিখলাম, পরাভব মেনে নেয়াটাই জীবন।

আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো শৈশব থেকে।

আমি জানলাম, পাখির স্বভাব মানুষের থাকতে নেই।

আমাকে ছেড়ে যেতে বলা হলো কৈশোর।

আমি বুঝলাম, এখানে অর্জিত আগুনে তৃষ্ণা পোড়াতে হয়।

তারপর আমাকে হত্যা করতে বলা হলো একটা সুবর্ণ যৌবন।

আমি দেখলাম, হত্যার পর হাত মাখা অস্ত্রের কান্না।

অবশেষে আমাকে নির্দেশ দেয়া হলো পরিপূর্ণ মৃত্যুর ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে এইসব বহুবিধ হত্যায়।

আমি এলাম। এখানে অনেক অপঘাত ও অপমৃত্যুকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

যারা এটা বহন করতে পেরেছে তাদের পুরষ্কৃত করা হলো।

আমি অনুভব করলাম, জীবনের লাশে কীভাবে বিছিয়ে থাকে বশ্যতার মাকড়।

১৫/১০/২০২২

  • মাথা কেটে নিয়ে বসে আছি

মাথাবিহীন একটা মানুষ এসেছে আমাদের লোকালয়ে।

কৌতূহলে আমরা জিজ্ঞেস করেছি তাকে, কী নাম তার।

আমরা জানতে চেয়েছি সভয়ে ও বিস্ময়ে কোথা থেকে এলো সে।

কীই বা তার পরিচয়।

সে নিরুত্তর।

আমরা তাকে প্রশ্ন করেছি সন্দেহ নিয়ে- সে কি আত্মগোপনে এসেছে এখানে, এই জনপদে? রাজদণ্ডে হয়েছে কি তার এই মুণ্ডুপাত?

নাকি স্বার্থের মোহে কেটে নিয়ে গেছে বন্ধু কিংবা স্বজন মুখচ্ছবি তার।

তখনো সে নির্বাক।

দ্রোহে প্রেমে অথবা বিপ্লবে সে কি বাজি রেখেছিলো ঠোঁটের দস্যুতা।

স্লোগানের গলা চেপে ধরে কেউ কি তার ছিঁড়ে নিয়ে গেছে স্বরতন্ত্রী।

আমরা তার জবাব চেয়েছি।

চেয়েছি এর সদুত্তর। তবুও সে উত্তরহীন। আমরা একত্রিত হলাম।

ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলাম মুণ্ডুহীন লোকটার নিশ্চুপ ধড়ের বিরুদ্ধে।

আমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে লোকটা তবুও নির্বিকার।

ফলে আমাদের বুঝতে বাকি থাকলো না লোকটার বোবা হয়ে ওঠার রহস্য।

এরপর আমরা সবাই মাথা কেটে নিয়ে বসে আছি নিস্তব্ধ নিরুত্তর এই লোকালয়ে।

১৭/১০/২০২২

  • শেষ দৃশ্যে পাখিটি মুক্তি পেলো

পাখিটি যখন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠলো আমি তার ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

তাকে ইচ্ছামৃত্যু থেকে প্রাণপণে ফেরাতে চাইলাম।

মৃত্যু অভিমুখী তার ডানায় তুলে দিলাম জীবনের প্রলোভন।

রেখে দিতে চাইলাম তার গতির সমান্তরালে মৃত্যুর মৌনতা।

সবশেষে পাখিটিকে আপন সত্তায় ঢেকে নিলে সে আরও মৃত্যু মাতাল হয়ে ওঠলো।

আমাকে অস্বীকার করে জীবনবিরোধী হয়ে পড়লো সে।

তার মনে হতে লাগলো অজাচারী এক শাসক আমি।

যে কিনা জীবনের মূল্যে কিনে নিতে চায় মৃত্যুকে।

আমাকে নিয়েই সে পালাতে থাকলো প্রতিস্পর্ধী ডানায়।

আমি তাকে নির্বাসনের ভয় দেখাই রাষ্ট্রনায়কের তর্জনীতে।

জীবনদ্রোহী তকমায় হুলিয়া জারি করি তার উদ্ধত মাথায়।

এরপর পাখিটি তার মুক্তির কথা ভাবলো।

এরপর পাখিটি তার স্বাধীনতার কথা ভাবলো।

এরপর পাখিটি তার স্বাধিকারের কথা ভাবলো।

কিন্তু জানা হলো না শেষদৃশ্যে পাখিটি মুক্তি পেলো কিনা।

নাকি পাখির জীবনে আমার মৃত্যু হলো ।

২০/১০/২০২২

  • পুরুষের গোঁফে ঈশ্বর বসে থাকেন

পুরুষ সম্ভবত গোঁফ চেঁছেই প্রথম নিজেকে গোলামরূপে আবিষ্কার করলো।

গোঁফের এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা আছে।

পুরুষ যখন ভ্রু বাঁকিয়ে বুড়ো ও তর্জনীর দ্রোহে ঘুরিয়ে দেয় গোঁফের উজান পৃথিবীতে তখন নতুন সভ্যতার তোপধ্বনি হয়।

পরাধীনতার সমুখে তেড়ে আসতে থাকে পুরুষের তেজোদ্দীপ্ত মুখ, প্রবল পরাক্রমে সে গিলে নেয় পৃথিবীর সব উপনিবেশ।

পুরুষ যখন প্রশান্ত হয়, গোঁফ নুয়ে আসে চিবুক ও প্রবল বুকের অভিমুখে; তখন সে ত্রিমুখ ব্রহ্মা।

পুরুষের গোঁফে ঈশ্বর তখন দুই পা বাবু দিয়ে বসে থাকেন।

ঈশ্বর আর পুরুষ ঠিক তখনই সমার্থক।

পুরুষ তখন গোঁফের আরশে সমাসীন চির অধীশ্বর।

তারপর দেয়ালে দেয়ালে পুরুষ লিখে দেয় নারীর স্তন আর পুরুষের গোঁফে চিরদিন লেগে থাকে সাম্রাজ্যবাদের চোখ।

২৩/১০/২০২২

  • জীর্ণ পুরনো পদবি সেলাই করি

তোমাদের নামের আগে কত শত পদবির ভিড়।

আমার না হয় থাকলোই হতদরিদ্র একটি নাম।

নামই আমার পরিচয়, গরিব অহমিকা। আমার পয়সা নেই।

নিদেনপক্ষে হাজী সাহেব বলেও ডাকবে না কোনোদিন কেউ।

অবশ্য মসজিদে যাবার জন্য নামাজী সাহেব বলে কেউ ডাকলেও ডাকতে পারতো।

ডাকেনি। সে কারণে আমার সামাজিক মর্যাদাকর কোনো পদবি নেই।

বংশ পরিচয়েও পদবির সুযোগ থাকে। যেমন, চৌধুরী সাহেব, খান সাহেবসহ আরও কত শত পদবি।

একদিন পদবির লোভে নিজের দুস্থ নামের পাশে চৌধুরী খান তালুকদার খন্দকার কত কী-ই জুড়ে দিলাম।

সমাজ স্বীকার করলো না।

পরিহাসের বাঁকা হাসি হলো আমার ইনাম।

পদবির লোভে আমি অসৎ হতে থাকলাম।

এটুকুই বুঝলাম, সসম্মানে বেঁচে থাকতে হলে পদবি আমার চাই-ই চাই।

এবার আমি বিদ্যানের পদবি চুরি করে ভুয়া বিদ্যান সেজে বসলাম।

ভূমিদস্যু সামন্তরা কেড়ে নিয়েছিলো তাদের নামে উইল করা বংশপদবি আমার; যা আমি চুরি করেছিলাম।

লোভে নয় সম্মান নিয়ে বাঁচার তাগিদে।

বিদ্যানের পদবি চুরি করার দায়ে রাষ্ট্র এবার আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো।

আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।

আমার সাজা হলো।

আমি ধীরে ধীরে বুঝলাম, রাষ্ট্র এবং সামন্তপ্রভু তাদের প্রয়োজনেই আমাদের দাস বানিয়ে রাখে।

এখন আমি যাবজ্জীবন বসে বসে মানুষের জীর্ণ পুরনো পদবি সেলাই করি।

২৫/১০/২০২২

  • ছেনি চলছে

হৃদয়ে অনেক পাথর জমেছে।

সরাতে চাই।

সরালে অবশ্য হৃদয়টাই চলে যায়।

আমি ভাস্কর।

সরে যেতে পারি না।

কেউ অবশ্য রসিকতা করে আমাকে বলে বসতে পারেন শিল্পী।

আর শিল্পী হলে তো কিছুতেই যাওয়া যায় না।

নিজের হৃদয়।

ভাবনাটা তাই প্রবল। ভুল হলে তো আর পাথরের রূপ বদলানো যায় না।

কী বানাই ওকে!

কী বানালে পাথরতা থেকে মুক্তি পাবে সে!

মিহি হাতে ছেনি চালাচ্ছি।

ভেঙে পড়া ওর খাঁজে খাঁজে দিচ্ছি ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি।

যাতে ছেনির আঘাতে জেগে না ওঠে আগুন কিংবা অনুনাদ।

ছেনি চলছে। হৃদয় রূপান্তরিত হচ্ছে। চোখের পানিও ফুরিয়ে আসছে ।

২৩/১০/২০২২

(Visited 52 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *