পোড়ামাটি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন কান্তজিউ মন্দির

শেয়ার করুন

উত্তরবঙ্গের অন্যতম জেলা দিনাজপুর। এই জেলার সঙ্গে মিশে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়। এই জেলাতেই বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তজির বা কান্তনগর মন্দির। মন্দিরটি পরিদর্শনের জন্য প্রতিদিনই শত শত মানুষ দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসছে।

মন্দিরের অবস্থান ও ইতিহাস :

মন্দিরটিকে কান্তজিউ বা কান্তজির আবার কান্তনগর মন্দির নামেও ডাকা হয়। এছাড়া নবরত্ন মন্দির নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। কারণ তিনতলা বিশিষ্ট মন্দিরের ৯টি চূড়া বা রত্ন ছিল। দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল উপজেলার কান্তনগর গ্রাম ঢেপা নদীর তীরে কান্তজিউ মন্দির অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে, শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। 

মন্দিরের উত্তর পাশে ভিত্তিদেবীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা ও জমিদার প্রাণনাথ রায় এই মন্দিরের কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে ১৭৫২ সালে মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ করেন।

Dhaka post

গঠন বিন্যাস, স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্য ইত্যাদির সংমিশ্রণে মন্দিরটি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত নয়নাভিরাম। জমকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোণগুলোর উপরে ৯টি অলংকৃত শিখর  রয়েছে। যা দেখে মনে হতে পারে একটি উঁচু ভিত্তির উপর একটি রথ দাঁড়িয়ে আছে। বর্গাকার একটি প্রধান প্রকোষ্ঠকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ইমারতটি নির্মিত হয়েছে। পাথরের উপর দাঁড়ানো মন্দিরের উচ্চতা ৫০ ফুটের বেশি নয়। মন্দিরের নিচ তলায় ৩১টি খিলান, দ্বিতীয় তলায় ৩১টি খিলান এবং তৃতীয় তলায় মাত্র ৩টি খিলান রয়েছে। মহাভারত-রামায়ণের নানা বিষয়ের উপস্থিতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথম পর্যায়ের অলঙ্করণে কৃষ্ণের নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজজীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার ও অভিজাতদের বিনোদন চিত্র রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের অলংকরণে বনের মধ্যে শিকার দৃশ্য, হাতি, ঘোড়া ও উটসহ রাজকীয় শোভাযাত্রা সুন্দরভাবে সজ্জিত আছে। এছাড়া পালকিতে বসে থাকা হুকা হাতে জমিদার, নদীর দৃশ্য, লোকজনে ঠাসা নৌকায় আনন্দ-উৎসবে মগ্ন দৃশ্যপটও বিদ্যমান। তৃতীয় ধাপের অলংকারে রয়েছে দানব রাজা কংস কিশোর কৃষ্ণকে বধ করতে উদ্যত, সারস গলার দানব বাকাসুর হত্যা, স্বর্ণ দানব কলিকায়ে দমন, লম্বা সরু নৌকায় কৃষ্ণের আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদি পোড়ামাটির ফলকগুলোতে ফুটে উঠেছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে মন্দিরের উপরের রত্নসমূহ ভেঙে পড়ে।

ভারত থেকে কান্তজিউ মন্দির দেখতে আসা এক দর্শনার্থী সমীক কুমার বসাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে শুনতাম বাংলাদেশের কান্তজিউ মন্দিরে আমার অন্ন প্রশান হয়েছে, সেই থেকে এই নয়নাভিরাম মন্দির দেখার ইচ্ছে। রাসমেলা উপলক্ষে আমার স্ত্রীকে নিয়ে মন্দির দেখতে আসছি। এত সুন্দর মন্দির আমাদের ভারতে ও আমি দেখি নাই। যখন এ মন্দির তৈরি করা হয়েছে, তখন কিন্তু এত প্রযুক্তি ছিল না। তারপরও মন্দিরের দেয়ালে হাতের ছোঁয়ায় কত সুন্দর কারুকাজ করেছে, যা দেখে মুগ্ধ আমি।

Dhaka post

ঠাকুরগাঁও থেকে মেলা দেখতে আসা দর্শনার্থী মিলন কুমার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছবি ও ভিডিওতে মন্দির দেখেছি। মন্দিরের কারুকাজ আজ নিজ চোখে দেখলাম। এক কথায় অসাধারণ। মন্দিরের দেয়ালে এত সুন্দর নকশা হাত দিয়ে করা যায়, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

দিনাজপুর হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ‍মিম ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দিন থেকে মন্দির দেখার ইচ্ছে ছিল। এখন রাস মেলা শুরু হয়েছে। সে উপলক্ষে মেলা দেখতে এসেছি। পাশাপাশি মন্দিরটিও দেখা হলো।

Dhaka post

কেন যাবেন কান্তজিউ মন্দিরে :

কাহারোল উপজেলার ঢেপা নদীর তীরের কান্তজির মন্দির টেরাকোটার স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। এই মন্দিরে ব্যবহৃত উৎকৃষ্ট টেরাকোটার ফলক আপনি দেশের আর কোথাও দেখতে পাবেন না। কান্তজির মন্দিরের বিখ্যাত রাসমেলা দেখতেও চলে যেতে পারেন উত্তরবঙ্গের সব থেকে প্রাচীন জেলা দিনাজপুরে। কান্তনগরের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর কাছে নিঃসন্দেহে আকর্ষণের।

যেভাবে যাবেন কান্তজিউ মন্দিরে : 

দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল উপজেলায় কান্তজির মন্দিরের অবস্থান। ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনে সরাসরি দিনাজপুর চলে আসতে পারেন। আবার আকাশ পথে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে বাসে করে দিনাজপুরের বারোমাইল নামক স্থানে নামতে হবে। এরপর এক কিলোমিটারের হাঁটা পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন শান্ত ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির কান্তনগর গ্রামে। অবশ্য বারোমাইল থেকে ভ্যানেও যেতে পারেন। কান্তজির দর্শন শেষ হলে অদূরে অবস্থিত নয়াবাদ মসজিদটি দেখতে ভুলে যাবেন না। ছোট্ট সুন্দর এই মসজিদের প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। আর কান্তজির মন্দিরের সঙ্গে বোনাস হিসেবে ঘুরে আসতে পারেন দিনাজপুরের আরও কিছু বিখ্যাত স্থান যেমন- রামসাগর, সুখসাগর, দিনাজপুর রাজবাড়ী ও শিংরা ফরেস্ট।

প্রসঙ্গত, শীতের মৌসুমে পিঠাপুলির কারণে উত্তরের এই জনপদ সব থেকে বেশি জনপ্রিয়। তবে এ সময় আসলে অবশ্যই শীতের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে।

(Visited 1 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *