খুন – আয়মান হিশাম

শেয়ার করুন

আয়মান হিশামঃ আপনি শিওর খুনটা বিশিষ্ট শিল্পপতি রাঘব রায় চৌধুরীই করেছে?
আলবৎ শিওর, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল দূর্গাপুর থানার ওসি সাদেকুল।
কথোপকথন চলছে দূর্গাপুর থানার ওসি সাদেকুল হোসেন আর পেশাদার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর বাদল খানের মধ্যে। এর আগে বেশ কয়েকটা জটিল কেস সমাধানে সাদেকুলকে সাহায্য করায় এবারও যথারীতি বাদলের শরণাপন্ন হয়েছে ওসি। বাদলের সঙ্গে থানায় উপস্থিত আছে ওর ছায়াসঙ্গী, ভুয়া সহকারী রকিব খানও।
জেনে বুঝে বলছেন তো আপনি কার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তাক করেছেন?’ জানতে চাইল বাদল।
অবশ্যই। একজন সমাজের বুকে ভাল মানুষের মুখোশ পরা অমানুষের বিরুদ্ধে। যে টাকা ও ক্ষমতার জোরে নিজের খেয়াল খুশি মত কাজ করছে।
সে যাই করুকগে, কিন্তু সে যে নিজের স্ত্রী সুনিতা দেবীকে খুন করেছে, এব্যাপারে কী এভিডেন্স আছে আপনাদের কাছে?
সুনিতা দেবী নিজে আমাদেরকে ফোনে জানিয়েছিল, তার স্বামী তাকে খুন করতে চায়। এজন্য সে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে…।
তার মানে এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা আছে! বাধা দিয়ে বলল বাদল। আর প্রমাণও পেয়েছেন নিশ্চয়। তাহলে আর ঝুলিয়ে রাখছেন কেন? যদি রহস্যটার সমাধান পেতে চান, তো পুরো ব্যাপারটা খোলাসা করে বলুন।
বেশ, খামোখাই একটু কাশল ওসি। তবে শুনুন।
রাঘব রায় চৌধুরী আর সুনিতা দেবীর বিয়ে হয়েছে প্রায় দশ বছর। কিন্তু ওঁরা নিঃসন্তান ছিল। ডাক্তারি পরীক্ষায় সমস্যাটা সুনিতারই ধরা পড়ে। তবুও স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসার কারণে হাসিমুখেই সেটা মেনে নেয় রাঘব। নিঃসন্তান হয়েও সমাজে ওরা সুখী দম্পতি হিসেবে পরিচিত ছিল। বছর খানেক আগে একটা নাইট ক্লাবে রাঘবের পরিচয় ঘটে তনুশ্রী রাণী নামে এক বার ড্যান্সারের সাথে। তারপরই বদলে যেতে থাকে রাঘব। মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় বেচারা। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। শারিরীক সম্পর্কের এক পর্যায়ে তনুশ্রী গর্ভবতী হয়ে পড়লে রাঘব বাবা হওয়ার খুশিতে গোপনে তনুশ্রীকে বিয়ে করে। কিন্তু স্ত্রী সুনিতার কারণে এবং সোসাইটিতে ওদের দাম্পত্য জীবনের সুনামের কারণে তনুশ্রীকে ঘরে তুলতে পারেনি রাঘব। ওদিকে দিনকেদিন মায়ের পেটে বাচ্চা বেড়ে উঠছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তনুশ্রীকে ঘরে তুলে সমাজে সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিশ্চিত করা দরকার। কিন্তু পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুনিতা। কাজেই ভেবে চিন্তে স্ত্রীকে দুনিয়া থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় রাঘব। একদিন রাতে সুনিতা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওকে কীভাবে খুন করা যায়, এনিয়ে তনুশ্রীর সাথে মোবাইলে ফন্দি আঁটছিল রাঘব। কিন্তু কপাল খারাপ ওদের। সব শুনে ফেলে সুনিতা। সেদিনই সে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে জানতে পারে। স্বামীর গোপন পরিকল্পনার কথা শুনেও নিজেদের সোসাইটি আর দাম্পত্য সুনামের কারণে স্বামীর ঘর ছাড়তে ব্যর্থ হয় সুনিতা। তাছাড়া সোসাইটিতে রাঘব একজন মহৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত। আর সুনিতার কাছে কোনও প্রমাণ নেই। ওর মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া রাঘবকে সে ভালোও বাসে। তাই মরণের ভয় থাকা সত্ত্বেও সে স্বামীকে ত্যাগ করতে পারেনি। আসলে ও বিশ্বাসই করতে পারেনি যে রাঘব ওকে খুন করতে পারে। কিন্তু সুনিতার বিশ্বাস ভুল প্রমাণ করে গত একমাসের মধ্যে তিন বার স্ত্রীকে খুন করার চেষ্টা চালায় রাঘব। নেহায়েত ভাগ্যের জোরে বেঁচে যায় সুনিতা। কিন্তু এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রাঘব। স্ত্রীকে খুন করতে মরিয়া রাঘব সুনিতাকে নিয়ে আজ থেকে পাঁচদিন আগে দূর্গাপুরের পানানগরে নির্জনে গড়ে তোলা নিজের বাগান বাড়িতে আসে। স্বামীর ঘৃণ্য প্লান বুঝতে পেরে সেদিনই গোপনে থানায় এসে পুলিশকে সব ইনফর্ম করে। আমাদের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা দাবী করে বসে মহিলা। রাঘব রায়ের সামাজিক মর্যাদার কারণে, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া মহিলার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করাটাও ঠিক বলে মনে হয়নি। কারণ সে যদি জানেই যে তার স্বামী তাকে খুন করতে বাগান বাড়িতে এনেছে, তাহলে সে পালচ্ছে না কেন? তবে এখন বুঝেছি কেন পালাতে পারেনি সুনিতা। তাহলে রাঘব তখন প্রচার করে দিত তার স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক ছিল, তাই সে ঘর ছেড়েছে। তাই নিজের সম্মানের কথা ভেবে পালাতে পারেনি মহিলা। যাইহোক, সবশুনে মহিলাকে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিলাম যে গোপনে তাদের বাড়ির উপর নজর রাখব আমরা। যদিও আমাদের আশ্বাসে তার পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আর কী-ই বা করতে পারত সে?
তো আমি রাঘবের বাড়ির উপর নজর রাখার জন্য আট ঘন্টা শিফট হিসাবে তিনজন কনস্টেবল নিয়োগ করি। ওদের কাজই ছিল সুনিতাকে ফলো করা। সুনিতা বাইরে বেরোলে তাকে ফলো করা, আর বাড়িতে থাকলে বাড়ির বাইরে অবস্থান করা। বলে রাখা ভাল, রাঘবের দুইতলা বিশিষ্ট বাগান বাড়ির চারপাশে উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত হওয়ায় বাইরে থেকে ভিতরে নজর চলে না। আমার লোকের কাজ ছিল শুধু সুনিতা বাইরে গেলে তার উপর নজর রাখা। কারণ আমি ভেবেছিলাম বাড়ির মধ্যে সে নিরাপদ। ওকে মারতে হলে বাইরে নিয়ে গিয়ে মারবে রাঘব। কিন্তু আমার ধারণা যে কত বড় ভুল ছিল, তা বুঝতে পারলাম দুইদিন পরে। আগের মতই বিকেলে স্ত্রীর সাথে বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যার পরে বাড়িতে ঢুকে যায় দুজনে। আমার লোকও ঢিলে ভাবে বাইরে বসে পাহারা দিতে থাকে। সেরাতে আর তেমন কিছুই ঘটে নাই। কিন্তু পরদিন সকালে থানায় রাঘবের ফোন পেয়ে চমকে যাই আমি। রাঘব থানায় ফোন করে জানায়, তার স্ত্রী সুনিতা লাখ দশেক নগদ ক্যাশ, কিছু দামী গহনাগাটি এবং রাঘবের নিরাপত্তার জন্য সর্বদা কাছে রাখা লাইসেন্স করা নাইন এম এম পিস্তলটা নিয়ে ভেগেছে। তাকে তার স্ত্রী রাতে খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। তাই সে কিছুই টের পায়নি। বাড়ির দারোয়ান ব্যাটাও রাতে ওদের সাথে খায়। ও বেচারাও বেঘোরে ঘুমিয়ে ছিল। পিস্তল নেয়ার কারণ জানিয়েছে রাঘব, সম্ভবত ওষুধের কার্যকারিতা কমে গেলে যদি সে বাধা দিত, তাহলে হয়তো গুলি করত সুনিতা। শুনে বুকের মধ্যে ধক্ করে ওঠে আমার। সাথে সাথেই রাতে রাঘবের বাড়িতে ডিউটিরত কনস্টেবল রবিকে ফোন দিই। সে হলপ করে বলল রাতে কাউকেই বাড়ি থেকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখেনি। সকালে ডিউটিরত রফিকও একই কথা বলল। বুঝলাম মিথ্যা কথা বলেছে রাঘব। যা বলেছে, আসলে ঘটেছে তার উল্টো। ও নিজেই রাতে স্ত্রী আর দারোয়ানের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল, যাতে নির্বিঘেœ স্ত্রীকে খুন করতে পারে। আর তাই যদি হয়, এতক্ষণে ওর পিস্তলটা দিয়ে স্ত্রীকে গুলি করে খুন করে লাশটা গুম করে ফেলেছে রাঘব। আর পূর্ব প্ল্যান মাফিক স্ত্রীর পালানোর গুজব ছড়ানোর ব্যবস্থা করে আমাকে জানিয়েছে, নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য। সম্ভবত পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো ছিল। তাই বাইরে দাঁড়িয়েও শুনতে পায়নি আমার লোক।
তাই যদি হয়, যেহেতু আমার লোক এখন পর্যন্ত ও বাড়ি থেকে কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখেনি, লাশ বাড়ির মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে হারামজাদা। তখনই ফোর্স নিয়ে ওর বাড়িতে রওনা হলাম আমি। রফিককে ফোন করে বলে দিলাম, কেউ যাতে ও বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে না পারে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে রাঘবের বাড়ি পৌঁছে রাঘবকে অবাক করে দিয়ে প্রথমে ওর হাতে হাতকড়া পরালাম। তল্লাশি শুরু করলাম ওর গোটা বাড়ি। চোখে প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে চাইল সে। অভিনয়ের ওস্তাদ। এমন ভাব করতে লাগল, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেনা। জানি প্রমাণ করতে না পারলে পরিণাম ভালো হবে না, তবুও ঠাটিয়ে ওর দুই গালে কষে দুই চড় মারলাম। স্ত্রীকে খুন করে কোথায় গুম করেছে জানতে চাইলে স্রেফ উড়িয়ে দিল। ওকে জানালাম, গত দুদিন ধরে ওর স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। গত সন্ধ্যায় তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেও বেরোতে দেখেনি আমাদের লোক। শুনে তো রাঘব হেসেই খুন। বলল, “হেই মিয়া, তুমরা পুলিশরা যে কেমন, তা জানা আছে আমার। ব্যাটা মনে হয় ডিউটি বাদ দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল।” ওর কথা শুনে রাগে পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কী-ই বা বলার আছে আমার?
যাইহোক, পুরো ফোর্সকে কাজে লাগিয়ে দিলাম। আমার ধারণা… ধারণা না, বিশ্বাস, সুনিতার লাশ এ বাড়িতেই আছে। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজল আমার বাহিনী। ঘরের মেঝে, বেজমেন্ট, ছাদ, চিলেকোঠা, বড় বাক্স, সুটকেস, আলমারি, গুপ্ত ঘর বা দরজা, পানির ট্যাংক মোট কথা, লাশ লুকানো যায় এমন যত রকম জায়গা আছে সব খুঁজেছি। শুধু বাড়ির মধ্যে না, বাড়ির বাইরে, বাগানে। এক কথায় কম্পাউন্ডের মধ্যে যত জায়গা ছিল সব জমি চাষ দেয়ার মত করে চষে ফেলেছি। ফলাফল অশ্ব-ডিম্ব। কিচ্ছু পাইনি। লাশের টিকি চিহ্নও নাই। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেও লাভ হয়নি। খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকায় বেঘোরে ঘুমিয়েছে বেচারা। সুনিতাকে মার্ডারের প্রমাণ তো পাইইনি, উল্টো রাঘবই তার স্ত্রীর বাড়ি থেকে পালানোর প্রমাণ দিল ভাঙা লকার আর খোলা সিন্দুক দেখিয়ে। বলল, গান র‌্যাকে রাখা পিস্তলটাও নিয়ে গেছে। রাগে হতাশায় বিধ্বস্ত আমি ওর ভালমানুষী মুখ বুজে সহ্য করলাম। সুনিতা যে খুন হয়েছে, লাশও আছে, নিশ্চিত আমি। তাই প্রধান সাসপেক্ট হিসাবে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ওকে থানায় প্রেফতার করে আনলাম। আমার মনে হয় রাঘব জানত, ওর স্ত্রীর পুলিশের সাহায্যের খবর। ওর মত ধনীর টাকা ও চরের অভাব নেই। যেহেতু স্ত্রীকে খুন করবেই, সেহেতু পূর্ব পরিকল্পনা অবশ্যই ছিল। সম্ভবত ওর স্ত্রীর উপর নজর রাখার জন্য লোক ঠিক করা ছিল।
থানায় এনে টর্চার করে লাভ হলো না। একটা কথাও বের করা গেল না। উপরন্তু বিকালের মধ্যেই ওর উকিল এসে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সঠিক অভিযোগের তদন্ত না করে উপরন্ত তার মক্কেলকেই উল্টো অহেতুক হয়রানি করার জন্য মানহানির মামলা করবে বলে হুমকি দিয়ে গেল। তারপরে একদিন এখানে ছিল রাঘব। গতকাল সন্ধ্যায় মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঢাকা চলে গেছে ও।
দীর্ঘ বয়ান শেষে থামল সাদেকুল। চুপচাপ গোটা ব্যাপারটা একটু নাড়া চাড়া করে বাদল তাকাল ওসির দিকে। বলল, সবই বুঝলাম। কিন্তু এখন আমাকে কী করতে বলেন?
সুনিতার লাশটা খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে।
ঠিক আছে। আমি রাজী। কিন্তু এতে আমার লাভ কী?
সুনিতার পরিবারের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওর খুনীকে আপনি ধরিয়ে দিতে পারলে তারা উপযুক্ত সম্মানী দিতে সম্মত আছে।
হয়ে গেল, একগাল হেসে সহকারীর দিকে তাকাল বাদল, কী বলো রকিব খান?
জী স্যার, খুশিতে গদগদ হয়ে বলল রকিব খান।
কোথা থেকে শুরু করতে চান? ওসির প্রশ্ন।
রাঘবের বাগান বাড়িতেই রহস্যটার সকল প্রশ্নের উত্তর আছে। আমি আপনার মুখে সব শুনে সমাধান একরকম ভেবেই রেখেছি। এখন শুধু ফিল্ডে গিয়ে দেখতে চাই বাদবাকিটা।
অ্যাঁ? এরই মধ্যে সমাধান করে ফেলেছেন! আমরা সারা বাড়ি চষে ফেলে থৈ পেলাম না! আর আপনি…!
ওটাই তো মজা, চোখ টিপে বলল বাদল। এখন চলুন যাওয়া যাক।
পনেরো মিনিটের মাথায় রাঘবের বাগান বাড়িতে হাজির হলো তিনজন কনস্টেবল সহ ওসি সাদেকুল, বাদল ও তার ভুয়া সহকারী রকিব খান। যথারীতি সদর দরজায় পাহারা দিচ্ছে পাহারাদার কাম কেয়ার টেকার রঘুনাথ। ওসিকে চেনে। বাধা না দিয়ে খুলে দিল দরজা। গাড়ি নিয়ে ড্রাইভওয়ে ধরে এগিয়ে গিয়ে গাড়ি বারান্দায় দাঁড় করিয়ে টপাটপ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। রঘুকে বাড়ির প্রবেশ দ্বারের চাবি নিয়ে আসতে বলল ওসি। নিষেধ করল বাদল। ‘আমাদের বাড়ির ভিতরে খোঁজার প্রয়োজন নেই। খুব ভাল ভাবেই সেখানে খুঁজেছেন আপনারা।
কিন্তু আমরা তো বাইরেও খুঁজেছি। ওদের চষে ফেলা পুরা কম্পাউন্ডটা ইঙ্গিতে দেখালো ওসি।
তা খুঁজুন, তবে একটা জায়গায় খোঁজেননি। আমাদেরকে খুনীর মত করে ভাবতে হবে। বলতে বলতে দলটাকে সুয়ারেজের লাইনের কাছে নিয়ে এলো বাদল। বলল, আমার ধারণা, রাতে স্ত্রীকে খুন করে লাশটা প্রথমে এই ড্রেনের মধ্যে নামিয়ে ডুবিয়ে রেখেছিল রাঘব। ড্রেনটা প্রাচীরের নীচ দিয়ে বেরিয়ে পিছনের জঙ্গল পেরিয়ে মূল রাস্তার ড্রেনের সাথে মিশেছে। প্রাথমিকভাবে লাশ লুকানোর এটা একটা চমৎকার জায়গা। এখানে সেদিন খুঁজেছিলেন? নিজেকে কষে একশ একটা লাথি মারতে ইচ্ছা করল সাদেকুলের। সেদিন যদি এখানে খোঁজার কথা ভাবত, তো এতক্ষণ জেলে থাকত রাঘব। কনস্টেবল রফিকের দিকে ওসিকে তাকাতে দেখে বলল বাদল, লাভ নেই স্যার, এখন আর লাশ ড্রেনে খুঁজলে পাবেন না। আপনার কি ধারণা খুনী এখনও লাশ আপনার জন্য ফেলে রেখেছে? জেল থেকে বের হয়ে সেই রাতে বাড়িতে ফিরে প্রথমেই লাশটা এখান থেকে সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে ফেলেছে। তারপর সবকিছু ঠিকঠাক হওয়া নিশ্চিত করে গতকাল লাগেজ টাগেজ নিয়ে কেটে পড়েছে। সম্ভবত লাশ লুকানোর সময়ও রঘুর খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল রাঘব। কারণ সে নিজের কুকীর্তির সাক্ষী রাখার ঝুঁকি নেবে না।
তাতো বুঝলাম, মাথা দোলাল ওসি, কিন্তু সেই নিরাপদ জায়গাটা কোথায়?
আন্দাজ করুন তো?’ মিটিমিটি হাসছে বাদল।
আপনি জানেন? অফিসারের চোখে বিস্ময়।
ঠিক জানি না। জানি বললে ভুল হবে। তবে অনুমান করতে পারি।
কোথায়?
আপনি একটু ভাবুন না। বলে দিলে তো সব মজা এখানেই শেষ।
ধুর মশাই, মজা রাখুন। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। বলে দিন।
আর কেউ পারবেন? উপস্থিত সবার দিকে তাকাল বাদল। এনি ওয়ান?
সবাই চুপ। কেউ বুঝতে পারছে না। ঠিক আছে বলেই দিই। ওসির দিকে ফিরল বাদল, বলুনতো কোনো জিনিস লুকানোর নিরাপদ জায়গা কোনটি?
চোখ পিটপিট করতে লাগল সাদেকুল। বুঝতে পারছে না।
আপনাকে যে কেন পুলিশে রেখেছে, বুঝিনা আমি। সহকারীর দিকে তাকাল, রকিব, তুমি পারবে?
মনে হয় স্যর।
বলো।
এমন জায়গা, যেখানে একবার খুব ভালোভাবে খোঁজা হয়েছে।
এগজ্যাক্টলি! খুশি হলো বাদল। কারণ, সেখানে নতুন করে আর কেউ খোঁজার কথা ভাববে না। আর ঠিক এই কৌশল ব্যবহার করে লাশ গুম করেছে রাঘব। পুলিশ তার সারা বাড়ি, বাগান চষে ফেলেও লাশ বের করতে পারেনি। পুলিস ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের খুঁজে যাওয়া জমিন পুনরায় খুঁড়ে লাশটা মাটিতে পুঁতে ফেললে আর কেউ সেটা খুঁজতে যাবে বা খুঁজে পাবে, ব্যাপারটা অকল্পনীয়। ঠিক এই কাজটাই করেছে ধূর্ত রঘু। এখন তার বাগানের নির্দিষ্ট একটা জায়গায় খুঁড়লেই অস্ত্রসহ লাশটা আবিষ্কার করতে পারব আমরা। দল বেধে বাদলকে অনুসরণ করে বাগানে চলে এলো ওরা। খুঁজছে সেই নির্দিষ্ট জায়গা। খুঁজতে খ্ুঁজতে বাদলের চোখেই পড়ল ব্যাপারটা। লাশ খুঁজতে যেয়ে সারা বাগানই দফা রফা করে ছেড়েছে সাদেকুল ও তার দল। সবই আলগা মাটি। সর্বত্রই খোঁড়ার চিহ্ন। তবে একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায় এই জায়গার মাটি পরে আবার খোঁড়া হয়েছিল। রঘুকে বলাতে আগেই দুইটা কোদাল এনে রেখে গেছে সে। বাদলের নির্দেশিত জায়গায় কোদাল দিয়ে খুঁড়তে শুরু করল দুজন কনস্টেবল।
সবাই টান টান উত্তেজনা নিয়ে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। পূর্বে খোড়ায় মাটি আলগা হয়ে আছে। বেশি বেগ পেতে হলো না ওদের। প্রথমে বেরেলো লাশের পা। গলে গেছে প্রায়। দুর্গন্ধে ছেয়ে গেল চারপাশ। রুমাল দিয়ে নাক চাপতে বাধ্য হলো সবাই। ধীরে ধীরে মাটি থেকে বেরিয়ে এলো সুনিতা দেবীর অর্ধগলিত লাশ। নাইন এম এম পিস্তলটাও পাওয়া গেল। যেটা দিয়ে গুলি করে মারা হয়েছে মহিলাকে। সাইলেন্সার এখনো লাগানই রয়েছে। একটা পলিমারের ব্যাগে ভরে মাটি চাপা দিয়েছিল রাঘব। দেখে খুশি হলো বাদল। ভালই করেছে। এতে করে পিস্তলের বাঁটে ফিঙ্গার প্রিন্ট পেতে সুবিধে হবে।
যাইহোক, অবশেষে মিসেস সুনিতার লাশ আবিষ্কার সম্ভব হলো। প্রোটেকশন চাওয়া সত্ত্বেও তাকে রক্ষা করতে না পারায় মর্মাহত হয়েছে ওসি সাদেকুল। রাঘবকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্টে পিস্তলে রাঘবের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। রাঘবও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। বাদলের কাজ আপাতত শেষ। এখন সে আছে নতুন কোনও রহস্যের অপেক্ষায়…।

(Visited 2 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *