তাজহাট জমিদার বাড়ি রূপকথার গল্পে ফেরাবে

শেয়ার করুন

পাঠ্যপুস্তকে পড়া আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা রূপকথার গল্পের মতোই যেন তাজহাট জমিদার বাড়ির ইতিহাস। প্রাচীন রঙ্গপুরে (বর্তমান রংপুর) এক সময় ব্যবসা হতো হীরা, মানিক ও জহরতের। বিক্রি হতো নামিদামি হীরা, মানিক ও জহরত খচিত তাজ বা টুপির। আর এই স্বর্ণ ব্যবসা শুরু করেছিলেন মান্না লাল রায়। যিনি সুদূর পাঞ্জাব থেকে রঙ্গপুরের মাহিগঞ্জে এসেছিলেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে।

সেই মান্না লাল রায়ের হাত ধরেই মাহিগঞ্জে বসত জমজমাট তাজের হাট। সেখানে পাওয়া যেত রাজা বাদশাহর চাহিদানুযায়ী অনেক মূল্যবান তাজ। এই তাজ বিক্রির হাটই সময়ের পরিক্রমায় প্রসিদ্ধি লাভ করে তাজহাট নামে। যা বর্তমান রংপুর মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে।

এই তাজহাট বাজারের কোল ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক তাজহাট জমিদার বাড়িটি। যার মূল ভবনটি ঐতিহাসিক এক প্রাচীন নিদর্শন। বর্তমান তাজহাট বাজার হতে উত্তর দিক দিয়ে প্রধান ফটক অতিক্রম করে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমে কয়েক’শ গজ পেরিয়ে জমিদার বাড়ির প্রধান প্রবেশ পথে আসা যায়।

Dhaka post

রঙ্গপুরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, মান্না লাল রায়ের তাজ বিক্রির হাট থেকে তাজহাটের নামকরণ হয়। আর সেই থেকেই জমিদার বাড়িটি পরিচিতি পায় তাজহাট জমিদার বাড়ি হিসেবে। এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন মান্না লাল রায়ের বংশধর রাজা গোবিন্দ লালের পুত্র গোপাল লাল রায় (জি এল রায়)। যিনি পরাক্রমশালী শাসক হিসেবে উনবিংশ শতাব্দীতে বৃহত্তর রংপুর শাসন করেন।

তার শাসনামলেই ১০ বছর (১৯০৮-১৯১৭) সময় ধরে বিভিন্ন নকশা ও কারুকাজ খচিত ভবনটি নির্মাণ করে প্রায় ২ হাজার নির্মাণশিল্পী। ৭৬.২০ মিটার দৈর্ঘ্য ভবনটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিদেশি সাদা মার্বেল পাথর। এতে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় দেড় কোটি টাকা।

বর্তমানে রংপুর মহানগরীতে হাতে গোনা যে কয়টা বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম তাজহাট জমিদার বাড়ি। আর এর ভেতরে গড়ে তোলা প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরটি। তাজহাট জমিদার বাড়িটি কোলাহলমুক্ত ছায়াঘেরা সবুজ সমারোহে পরিবেষ্টিত আকর্ষণীয় পরিবেশে অবস্থিত। যার চারদিকে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ শোভা, ফুলের বাগান, উত্তর ও দক্ষিণে কামিনী, মেহগনি, কাঁঠাল ও আম বাগান। রয়েছে সমসাময়িককালে খনন করা বিশাল আকৃতির চারটি পুকুর।

Dhaka post

দূর থেকে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মতো দেখতে জমিদার বাড়ির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে মহারাজা গোপাল লাল রায়ের ব্যবহৃত নানা জিনিস। জমিদার বাড়িটি লাল ইট, শ্বেতপাথর ও চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত হওয়ায় দেখতে চমৎকার। দ্বিতীয়তলা বিশিষ্ট বাড়ির ভেতরে রয়েছে অসংখ্য কক্ষ, গোসলখানা ও অতিথি শয়নশালা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনের কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি গড়া সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে। জমিদার বাড়ির সম্মুখভাগ ৭৬ মিটার। সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি প্রশস্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি সরাসরি দোতলায় চলে গেছে। সেখানে দুটি বড় কক্ষ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাদুঘরে রয়েছে পুরোনো পাণ্ডুলিপি, সম্রাট-কবিদের হাতে লেখা চিঠি, যা দর্শনার্থীদের ফিরে নিয়ে যাবে রাজা-বাদশাহদের আমলে। আর নিচের তিনটি ছোট-বড় কক্ষ অফিসের জন্য।

জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে ঐতিহ্যবাহী এ জমিদার বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ৫৫ একর জমিসহ এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউটকে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ রংপুরের সন্তান তৎকালীন সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বাড়িটিকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন হিসেবে উদ্বোধন করেন। এতে আইনি সেবা পেতে রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে আসে।

Dhaka post

কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যায় জমিদার বাড়ির গল্প। ১৯৯১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে হাইকোর্ট ডিভিশন ওঠে গেলে ১৯৯৫ সালে রাজবাড়িটি ১৫ একর জমিসহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৫ সালে তাজহাট জমিদার বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিএনপি সরকারের তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান।

জাদুঘর ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ছোট কোরআন শরীফ, মোঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের লেখা খুৎবা, মহাকবি শেখ সাদির লেখা কবিতা, নারী মহীয়সী বেগম রোকেয়া, শিবলিঙ্গ, কষ্টিপাথরের মূর্তি, শিলামূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, প্রাচীন মুদ্রা, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত কিছু চিঠিসহ প্রায় শতাধিক বিরল প্রত্নতত্ত্ব নির্দশন রয়েছে। আরও রয়েছে রাজা গোপাল রায়ের ব্যবহৃত দাঁড়িপাল্লা, পুরোনো দিনের টেবিল-আসবাব, হাতে লেখা মহাভারত, মহাস্থানগড়ের পোড়ামাটির ফলক, কালো পাথরের মূর্তি, সরলা দেবীর মূর্তি, সাঁওতালদের ব্যবহার করা তীর-ধনুক। আছে আরবি, ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার শিলালিপি।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া প্রতিদিনই তাজহাট জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা জাদুঘর দেখতে দেশ-বিদেশের হাজারো দর্শনার্থী ভিড় করেন। দর্শনার্থীর তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, নাগরিক ও দর্শনার্থী। তবে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। আর বন্ধের দিন শুক্র ও শনিবার এক হাজারের বেশি লোকের সমাগম হয়।

Dhaka post

এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ ফি ২০ টাকা। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ৫ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের লোকদের ১০০ টাকা ও এর বাইরে বিদেশি পর্যটকদের ২০০ টাকা প্রবেশ মূল্য। 

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০০৫ সালে জমিদারবাড়ি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন। গত বছরের জুন মাস থেকে চলতি বছরের ১৫ মে পর্যন্ত ২ লাখ ১৭ হাজার ৮৩ জন দর্শনার্থী এ জাদুঘরে আসেন। তাদের মধ্যে বিদেশি ছিল ৮২ জন। জাদুঘরের প্রবেশ টিকিট থেকে গত এক বছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

Dhaka post

বর্তমানে রংপুর প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর ও তাজহাট জমিদার বাড়িতে একজন কাস্টডিয়ানসহ ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এছাড়া ১২ জন কর্মচারী অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন। নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৫ জন আনসার সদস্য আছেন।

এদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রংপুর অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে তাজহাট জমিদার বাড়ির সঙ্গে যুক্ত জাদুঘরটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। জাদুঘরের সংগ্রহ আরও বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এখানে উন্নতমানের পিকনিক স্পট ও পর্যটন নগরী গড়ে তোলার জোর দাবি সচেতন পর্যটকপ্রেমীদের।

Dhaka post

ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে ঘুরতে আসা এম এ সামাদ বলেন, রংপুরে বহুবার এসেছি। কিন্তু কখনো তাজহাট জমিদার বাড়িতে আসা হয়নি। বন্ধুদের সঙ্গে এবারই প্রথম এসেছি। এত সুন্দর রাজবাড়ি ও সবুজ মনোরম পরিবেশ দেখে ভালো লাগছে। গাছগাছালিময় এই সবুজ পরিবেশ অত্যন্ত সুন্দর।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর দেখা মিলল প্রবেশ ফটকের ডান পাশের ফুলবাগানে। তাদের মধ্যে শিপন তালুকদার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, রংপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এটি একটি। অনেক দিন পর তাজহাট জমিদার বাড়ি দেখে ভালো লেগেছে। বিশেষ করে এখানকার জাদুঘরের ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্রাচীন আমলে ফিরে গেছি।

দিনাজপুর থেকে দল বেধে আসা সোহাগ গাজী বলেন, আমরা প্রতি মাসেই বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে ঐতিহাসিক নির্দশন দেখে থাকি। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুর জাদুঘর দেখতে এসেছি। এখানে জাদুঘরে অনেকগুলো প্রাচীন ও দুর্লভ নির্দশন রয়েছে। যা আগে কখনো দেখিনি। আর বাাইরের সবুজময় প্রকৃতিটাও উপভোগ করার মতো। চারপাশ গাছগাছালি, ফুলের বাগান আর পুকুরে থাকা শাপলা ও পদ্মফুলের সমারোহে মন ছুঁয়ে গেছে। সংগৃহীত

(Visited 2 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *