প্রেমের প্রথম উপহার – রবিন রহমান

শেয়ার করুন

টেলিভিশন রিপোর্টার আসিফ রবি বই মেলার অনুষ্ঠান লাইভ টেলিকাস্ট করতে ব্যস্ত। মাইক্রো ফোন হাতে নিয়ে হেটে চলেছে। বই মেলাতে আগত সকল পাঠক ও লেখকদের অনুভূতি জানতে মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অত্যন্ত খুটিয়ে-খুটিয়ে দেখছে। ভালো একটা নিউজের আশায়। হাতে কাগজ ও কলম। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো লিখে রাখছে। মাঝে-মাঝে সঙ্গে থাকা ক্যামেরা ম্যান বাঁকি বিল্লাহকে ফুটেজ নিতে ইশারা করছে। সে খুব মনোযোগ সহকারে ভিডিও ফুটেজ নিয়ে চলেছে…।
সারাদিন কাজ শেষে সন্ধার দিকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয় রবি। বই মেলা থেকে যাবার আগে রবি নিজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেছে অন্য একজন রিপোর্টারকে। অফিসে গিয়ে ক্যামেরার মেমোরি কার্ডটা বের করে সেটি কম্পিউটারে চালিয়ে দেখতে থাকে রবি। ধারন করা ফুটেজ থেকে বেছে কিছু অংশ চালানো হবে টিভিতে। দেখতে দেখতে হঠাৎ রবির চোখ আটকে যায় একটা মেয়ের উপর। মেয়েটির ভিডিও করা যে জায়গা সেটা কয়েক বার টেনে-টেনে দেখে রবি, রাস্তাদিয়ে একা হেঁটে যাচ্ছে। চোখ আর নাক তার নিচে ঠোঁট, যে কম্বিনেশন মেয়েটার চেহারা ফুটে উঠেছে তাতে রবি কে ক্ষণিক সময়ে খুব কাছে টেনে নেয় মেয়েটি। মেয়েটিকে যে করে হোক পেতে চায় রবি। কোন মডেল বা অভিনয়ের কাজের জন্য না। জীবন সঙ্গী করে নিতে চায় মেয়েটিকে, রবি। কিন্তু মেয়েটিকে পেতে হলে তার ঠিকানা জানতে হবে। অফিসের কারো কাছ থেকে এ ব্যপারে পরামর্শ নেয়া যায়। নিজের ডেক্স থেকে উঠে গিয়ে উপস্থাপক কলিগ রুনার কাছে গিয়ে বসে রবি। ল্যাপটপটা চালু করে ভিডিও ফুটেজটা প্লে করে। রুনাকে দেখিয়ে বলে, আচ্ছা বলোতো একটা মেয়েকে ভিডিও ফুটেজে পেয়েছি, কিন্তু তাকে এখন আমার খুব দরকার। তাকে কিভাবে পাওয়া যেতে পারে? কোন পরামর্শ দিতে পারো? একটা টিভি চ্যানেলে কাজ করে যদি এই যুগে একটা মেয়ের ঠিকানা খুঁজে পেতে এ কথা বলো, তাহলেতো সকলে হাসবে। ফুটেজটা বই মেলার না? তাহলে এক কাজ করো, দেখো ভিডিওতে মেয়েটা কোন বইয়ের স্টলের সামনে ধরা পরেছে। তখন ওই স্টলে যেয়ে বই বিক্রির তালিকা থেকে বের কর মেয়েটা কোন বই কিনেছে। তথ্যটা পেলে মেয়েটার কেনা বইটাকে দিনের বই কেনার উইনার হিসাবে জয়ি ঘোষণা দাও তোমার মাইক্রো ফোনে। দেখবে টিভিতে দেখলে বা কোন ভাবে জানলে মেয়েটির হয়ে কেউ না কেউ ঠিকি পুরস্কার নিতে আসবে। আর এলেই তো তুমি ঠিকানা পেয়ে গেলে। আর ঠিকানাটা পেলেই তো মেয়েটিকে তুমি পেয়ে গেলে।
কলিগকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারে না রবি। একটা নতুন আইডিয়া পাওয়া গেলো। আস্তে আস্তে রবি নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। বন্ধু রাহাত কে ফোন দেয়। রাহাত অন্য একটা টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার তাই সে তখন বই মেলার লাইভ প্রোগ্রামে ছিলো। ওপাশ থেকে রাহাত ফোন ধরতে রাহাত কে ঘটনাটা খুলে বলে রবি। তারপর দিনের ধারনকৃত পুরো বই মেলার ফুটেজ টা চেয়ে নিজের মেইলে পাঠাতে রাহাত কে অনুরোধ করে। রাহাত আর না করে না। কিছু সময়ের মধ্যে মেইলটা পেয়ে যায় রবি। অবশেষে পেয়ে যায় মেয়েটার ফুটেজ। ‘ণ’ পাবলিকেশনের স্টলে মেয়েটিকে কোন একটা বই কিনতে দেখা যাচ্ছে ভিডিও ফুটেজে। অফিস শেষে বাসায় এসে ফ্রেশ হয় রবি। রাতটা পার হতে সকালে আবার বেরিয়ে পরে অফিসের উদ্দেশ্যে। নিজের ইউনিট নিয়ে বই মেলাতে পৌঁছে প্রথমে ‘ণ’ পাবলিকেশনের স্টলে গিয়ে পরামর্শ করে স্টলের মালিকের সাথে। বই বিক্রির লিস্ট থেকে সময় বিবেচনায় জানতে পারে মেয়েটির নাম ঐশ্বি। স্টলের কর্ণধারের অনুমতি নিয়ে ঐশ্বির কেনা বই টাকে গত দিনের পাঠক দের বই কেনা লটারির জয়ি ঘোষণা করে রবি লাইভ প্রোগ্রামে। অনুষ্ঠান চলা অবস্থাতে বারবার স্টলের নাম আর ঐশ্বির নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর অপেক্ষা ঐশ্বির কাছে ঘোষণাটা পৌঁছায় কি না। অবশেষে সন্ধার একটু আগে রবির অপেক্ষা শেষ হয়। একটা চৌদ্দ পনেরো বছরের ছেলে স্টলে হাজির হয়। স্টলের মালিক রবিকে ফোনে বিষয়টা বলতে রবি আর দেরি করে না। সোজা স্টলের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয় লাইভ টেলিকাস্ট সহ। ছেলেটা কে লাইভে নিয়ে জিজ্ঞেস করে ঐশ্বির সাথে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে। রবি জানতে পারে ছেলেটার নাম মিহির। ঐশ্বির ছোটভাই। বাড়ির ঠিকানাটাও পেয়ে যায় রবি। সব শেষে তার যে চেষ্টা সেটা হলো ঐশ্বির ফোন নাম্বারটা পাবার। সেটাও সফল হয় রবির। তবে লাইভে না, পুরস্কার প্রদান শেষে ঐশ্বির ফোন নাম্বারটা চাইলে সে না করে না।
রাত তখন এগারোটা পেরিয়ে গেছে। রবি অফিস থেকে বাসায় ফিরে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। বেডে যাবার পূর্বে ফোনটা হাতে নিয়ে ঐশ্বির নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়। হ্যালো কে বলছেন? নিজের পরিচয় দেয় রবি। ঐশ্বি অবাক হয়ে বলে, ভাইয়া আপনি! আমিতো ভাবতেই পারিনি আপনি ফোন দিবেন। দিলামতো, বলল রবি। তুমি কেমন আছো? হ্যা ভালো ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? এখন ভালো। তা পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে তোমার? অনেক ভালো লাগছে ভাইয়া…। দু’জনের মধ্যে অনেক্ষণ কথা চলল। রবি জানতে পারে বেসরকারি একটা ভার্সিটিতে পড়ে ঐশ্বি। কথায়-কথায় রবি ঐশ্বির কাছে জানতে চায় সে কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িতো কিনা। উত্তরে ঐশ্বি না বলে জানায়। অবশেষে রবি যেটা জানায় সেটা হলো কাল চৌদ্দ ফেব্র“য়ারি কোন কাজে বাহিরে বের হবে কিনা ঐশ্বি। উত্তরে ঐশ্বি বলে, না।
তাহলে কি কাল একবার বই মেলাতে আসতে পারবে? বলল, রবি।
কেনো, বলুনতো?
সেটা বলা যাবে না। তবে আশা করি তোমার বাবা মা কিছু মনে করবেন না।
ঐশ্বি না করতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারেনা কেনো। কথা শেষে ফোন রেখে দুজনে যারযার মতো ঘুমাতে যায়…। সকালে ঘুম থেকে উঠে রবি খুব সেজে গুজে বের হলো অফিসের উদ্দেশ্যে। বসন্তের গন্ধবিলোল আকাশে, মাদকতাপূর্ণ বাতাসের প্রবাহে আজ রবি যা করতে যাচ্ছে এমন ঘটনা এর আগে কখনো হয়নি হয়তো বই মেলার ইতিহাসে। নিজের ইউনিট নিয়ে বই মেলাতে লাইভ প্রোগ্রামে ব্যস্ত হয়ে যায় রবি। কিন্তু বিকেল চারটা বাজার আগে একটু অস্থির হয়ে যায় মন। বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে রবি। একগুচ্ছো ফুলের সৌরভ নিয়ে পিছে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরা ম্যান বাঁকি বিল্লাহ। হঠাৎ রবির চোখ আটকে যায় একটা মেয়ের দিকে। স্লিম স্যান্ডেল, সোনালি পাড়ের লাল শাড়ি পরা লম্বামতো একটা অতি সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটা হাসি মাখা মুখে হেঁটে আসছে বাংলা একাডেমির গেট দিয়ে বই মেলার ভেতরে। মেয়েটা আর কেউ না, ঐশ্বি! যাকে পাবার জন্য আজ তিনদিন নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে রবি। হাতের মাইক্রো ফোনটা এক সহকারির হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় সামনে। ক্যামেরা ওকে ফলো করছে, দেখতে দেখতে অনেক গুলো চ্যানেলের ক্যামেরা একসাথে ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। রাস্তায় ঐশ্বির পথ আটকে রবি দাঁড়ায় ওর সামনে। তারপর এক হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে রবি, ঐশ্বিকে উদ্দেশ্য করে ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরে বলে:
মোটামুটি ভালো একটা চকুরী করি। মাস্টার্স করেছি, শিক্ষা পর্যাপ্ত, বাবার বাড়ি, তাদের সুন্দর সংসার শুধু তাদের একমাত্র ছেলের প্রেম চাই। প্রেম শেষে বিয়ে, আমাকে বুঝে নেবার অনেক সময় পাবে এই প্রেমের দিনগুলোর মধ্যে। আমার মতো একটা গো বেচারা পুরুষের সাথে প্রেম করবে? তারপর বিয়ে?
সারা দেশের টিভি চ্যানেলে সকল দর্শক যেন রবির জন্য দোয়া করে যাচ্ছে। দর্শক চায় ঐশ্বি যেনো রবির প্রস্তাব মেনে নেয়।
অবশেষে একগুচ্ছো মিষ্টি হাসি দিয়ে রবির হাতের ফুলের তোড়াটা নিজের হাতে তুলে নেয় ঐশ্বি, ফুলের তোড়াটার নিচে একটা বই। বই মেলাতে প্রেমের প্রথম উপহার। সকলের ভিরে ঐশ্বির বাবা-মা আর রবির বাবা-মা ও যেন একসাথে সফলতার দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে। টিভির সামনে ড্রয়িংরুম গুলোতে যেন করতালির বাজনা বেজে ওঠে, শব্দের সমুদ্রে ভাসে পুরো দেশ।

(Visited 4 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *