লালদিঘী – আয়েশা সিদ্দিকা

শেয়ার করুন

আর দশ মিনিট পরেই রাজবাড়ি, দশ মিনিট পরেই রাজবাড়ি। জিনিসপত্তর গুছায়ে লন সবাই। বাসের কন্ট্রাক্টর বলতে শুরু করেছে…।
নুপুর আর শাহেদের বিয়ের বয়স পুরো একবছর হয়নি এখনও। ৭ মাস ১৩ দিন। শাহেদের বড় ভাইয়ের মতে হানিমুনটা বিয়ের ছ’মাসের মাঝেই সেরে ফেলা উচিত। কিন্তুু শাহেদ মহাব্যস্ত এক কর্মকর্তা। তাই এই দেরিটুকু। তবে শাহেদের ইচ্ছে ছিলো সুইজারল্যান্ড বা প্যারিসে যাওয়ার। নূপুরের ইচ্ছায় রয়েল রিসোর্টে যাওয়া।
রিসোর্টে পৌঁছানোর পর নির্ধারিত রুমে ব্যাগেজ রেখে পুরো রাজবাড়ি দেখতে বের হলো শাহেদ আর নূপুর। বিয়ের পর ওদের প্রথম একসাথে বের হওয়া। ঘুরতে বেশ ভালোই লাগলো দুজনের। বিশাল জায়গা জুড়ে পুরোনো রাজবাড়িটা। তবে রিসোর্টটা নতুন। বড়জোর ৫/৬ বছর হবে নির্মাণ বয়স। নূপুর খুঁটেখুঁটে দেখছে সবকিছু। ঘুরতে ঘুরতে একটা গোলাপ বাগানের মধ্যদিয়ে ওরা হঠাৎ একটা বড় দিঘীর সামনে এসে দাঁড়ায়। কেমন অদ্ভুতভাবে ঢেউ খেলছে দৃশ্যমান কালচে সবুজ পানি। তবে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার হলো ঠিক মাঝ দিঘীতে গোটা পঞ্চাশেক পদ্মফুল ফুটে আছে। নূপুর অবাক হয়ে দেখছে! এ দিঘীর চারপাশে একটু বেশিই নৈশব্দ…।
নৈশব্দতা ভেদ করে বাগানের বৃদ্ধমালিটা বলে উঠলো, “বাবু, দিঘীর পাড়ে নামবেন না। বড় পেছলা হয়ে গেছে। পা ফস্কাতে পারে। ওহ্ আচ্ছা! বলে শাহেদ নূপুরকে নিয়ে ফিরে আসতে লাগলো। ঠিক ঐ সময়ই একটা মাঝারি সাইজের মাছ পুকুর থেকে লাফিয়ে নূপুরের পায়ের কাছে এসে পড়লো। নূপুর হালকা চিৎকার দিয়ে কয়েক কদম সরে গেলো। বাগানের মালি ছুটে এলো। হাতের লাঠি দিয়ে মাছটার উপর একটা বাড়ি দিতে যেয়েও না দিয়ে বিবর্ণ মুখে তাকিয়ে রইলো। শাহেদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, মাছ চাষ হয় নাকি? মালিটি একবার নূপুর আর একবার শাহেদের দিকে ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে বললো, নাহ। আপনাগোর দুপুরের খাওয়ার সময় হইছে। খাইতে যান। ওরা আর কথা না বাড়িয়ে রিসোর্টের দিকে হাঁটা ধরলো। এমন করলো কেন? মনে হয় ইচ্ছে করে ওনার দীঘির মাছ তুলেছিলাম! বললো নূপুর। আমিও তাই ভাবছি! তবে বৃদ্ধ মানুষের মন মর্জি বোঝা বড় দায়। সরল উত্তর শাহেদের।
দুপুরে খাওয়ার পরে নূপুরকে বললো শাহেদ, ভূতে তো মনে হয় বিশ্বাস করো না? প্রশ্নই ওঠে না! দৃঢ় উত্তর নূপুরের। তুমি? আরে নাহ। তবে এসব পুরাতন বাড়িঘর সুবিধার না বুঝলা? তাই! তো আমার সাহেব দেখি ভয় পেতে শুরু করেছে। উহুঁ। বাগানের মালির আচরণটা কেমন যেন লাগলো। তা একটু আমারও লেগেছে। তবে পদ্মফুলগুলো খুব দারুণ না? হুম। আমায় দু’টো এনে দেবে প্লিজ? কি করবে? অবাক হয় শাহেদ। খোঁপায় গুজবো। খোঁপা করার জিনিসের অভাব বুঝি? তা হবে কেন? আচ্ছা লাগবে না। দুজনের খুনসুটিতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। শাহেদ রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কথা বলার জন্য বাইরে যায়। নূপুর তখন একতলা রিসোর্টের বেডরুমের ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এখান থেকে রাজবাড়ির দীঘি, গোলাপ বাগান বেশ খানিকটা দেখা যায়। হঠাৎ ওর মনে হলো কে যেন হেঁটে এদিকে আসছে। আরে শাহেদই তো! কিন্তুু ভিজে গেছে কেন? নূপুর কৌতুহলী চোখে চেয়ে আছে। শাহেদ বারান্দার গ্রিলের ওপাশে এসে দাঁড়ালো। বামহাতটা গ্রিল ধরে দাঁড়ানো নূপুরের ডানহাতে রাখলো। তারপর ডানহাতটা ধীরে ধীরে পেছন থেকে সামনে আনলো। নূপুর এতক্ষণ অবাক হয়ে শাহেদের কর্মকান্ড দেখছিলো। এখন অস্ফুট শব্দে বলে উঠলো, পদ্ম! শাহেদ কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলো। নূপুর ডানহাতটা শাহেদের হাত থেকে ছাড়িয়ে পদ্মগুলো হাতে নেয়। তুমি মনেই রেখেছো? ওর চোখেমুখে বিস্ময় মিশ্রিত আনন্দ। জবাবে শাহেদ একটু হাসে। কিছু বলে না। তবে ওর দৃষ্টিটা কেমন যেন অচেনা লাগে নূপুরের। কেমন স্থির, গভীর এক দৃষ্টি! এরকম শাহেদ কখনও দেখেনি এমন মনে হয়। ও একটু লজ্জা পেয়ে যায়। দাঁড়াও আমি এক্ষুনি খোঁপায় পরে আসি বলে দৌড়ে রুমের ভেতর চলে যায় নূপুর। খোঁপায় ফুল গুঁজে এসে শাহেদকে সে আর কোথাও দেখতে পায় না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রুমে চলে যায় নূপুর।
মাগরিবের নামাজের পর রুমে আসে শাহেদ। নুপুরকে বলে, জানো এলাকায় সুন্দর একটা মসজিদ আছে, তাই ওখানেই নামাজটা পড়ে এলাম। একা থাকতে তোমার কোন সমস্যা হয় নি তো? নূপুর মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। কী ব্যাপার? দাসের কোন অপরাধ? চোখে দুষ্টুমি নিয়ে বলে শাহেদ। তোমায় দাড়াতে বললাম দাঁড়ালে না কেন? তুমি যাওয়ার বেশ পরেই তো আযান দিলো। একটু দাঁড়ালে কি খুব দেরী হতো? নূপুরের কণ্ঠে অভিমানের সুর। মানে? কখন দাঁড়াতে বললে? শোন নি? কিছুক্ষণ আগেই না তোমাকে দাঁড়াতে বলে খোঁপায় ফুল নিতে গেলাম! কিসের ফুল? অবাক হয়ে বলে শাহেদ। কিসের ফুল মানে? সবসময় ফাইজলামি ভাল্লাগে না কিন্তুু! ফাইজলামি করবো কেন? কিসের ফুল, কি বলো কিছুই তো বুঝি না। ভ্রু যুগলে ভাজ পড়ে শাহেদের। কিছুক্ষণ আগে তুমি এই ফুল বারান্দায় দিয়ে গেলা না আমায়? নূপুর মাথার ওড়না ফেলে খোঁপার ফুল দেখায় শাহেদকে। নূপুরের কালো খোঁপার পাশে লালটুকটুকে দু’টি পদ্ম অপূর্ব দেখাচ্ছিলো। শাহেদ এবার আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, এ ফুল কই পেলে তুমি? কাকে দিয়ে আনালে! উফ্! নূপুর বিরক্তি প্রকাশ করল। সত্যিই আমি আনিনি এই ফুল, বলল শাহেদ। আমি ভেবে রেখেছি কাল কয়েকটা তোলানোর ব্যবস্থা করবো। কিন্তুু শাহেদ তুমিই তো আনলে। ভেজা গা ছিলো। আমি ভাবলাম দিঘীতে নেমেছিলে। ওহ্ তাইতো! এত তাড়াতাড়ি তোমার গা শুকিয়ে গেলো কি করে? শাহেদ চমকে যায় একটু। এভাবে মজা করার মেয়ে নূপুর না। তবে কি রিসোর্টের কোন ছেলে সুযোগ পেয়ে মজা করেছে? মস্তিষ্কে চিন্তাগুলো ঘুরছে শাহেদর। কী হলো? কিছু না। তুমি স্পষ্ট দেখেছো আমাকে? অবশ্যই। নূপুর খুলে বললো সব। শাহেদ আর কথা বাড়ালো না। ভড়কে যাবে মেয়েটা। তার চেয়ে বরং ও নিজেই বিষয়টা জানার চেষ্টা করবে। ফুলগুলো পানির বোতলে রেখে দিলো নূপুর। শাহেদ বারান্দাটা লক করে দিয়ে ফুলগুলোর দিকে এক নজর তাকালো। তারপর নূপুরকে বলল, একটু আসছি। তুমি রুমেই থাকো, বলে বাইরে চলে গেলো। শাহেদ মেলাতে পারছে না কিছু। আসর নামাজ পড়ে সেই যে বাইরে গেছে মাগরিবের পর এসেছে। এর মধ্যে কে এমন করলো? ম্যানেজারকে ডেকে বিস্তারিত বলল ও। সব শুনে কেমন চমকে গেলো ম্যানেজার! আমরা ক’দিনের জন্য এসেছি এখানে। সিকিউরিটি দেয়া আপনাদের দায়িত্ব। কিন্তুু এটা কেমন কথা? একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে শাহেদ। দুঃখিত স্যার! দুপুরের পরে রিসোর্টে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। কেউ প্রাচীর টপকে এসেছে হয়ত। হোয়াট? সরি স্যার, প্রাচীরে কাঁটাতারসহ সব বাঁধা তৈরী আছে। কিন্তুু কিছু স্থানীয় ছেলেপেলে বড্ড গেছো। আমি গার্ডকে আরো সতর্ক হতে বলবো। মনে থাকে যেন। বলে রাশেদ রুমে চলে গেলো। রাশেদ চলে যাবার পর ম্যানেজার মালির থাকার ছোট টিনের দোচালা ঘরটাতে ছুঁটে গেলো…।
রাতে নূপুরের সাথে এই নিয়ে আর কোন কথা হলো না ওর। ৬ ঘণ্টা জার্নিতে ক্লান্ত দু’জন ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সন্ধ্যায় শাহেদ আর নূপুর হাঁটতে বের হলো। রাজবাড়ি এবং রিসোর্টের মাঝ বরাবর দিঘী আর গোলাপ বাগান। গোলাপ বাগানে পৌঁছানোর পরপরই মালির সাথে দেখা হয়ে যায় ওদের। কেমন হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছিলো ওদের দিকে! ওরা থামলো। বাবু, কিছু কথা বলতাম।” আমতা আমতা করে বলে মালি। জ্বী বলুন। শাহেদ এগিয়ে যায়। না মানে, গিন্নিমার না শোনাই হয়ত ভালো। আমার সাথে একটু ম্যানেজার সাহেবের কাছে চলুন। নিচু গলায় বলল উনি। শাহেদ পেছন ঘুরে নূপুরের দিকে তাকায়। নীল রঙা একটা গোলাপ ছুঁয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছে মেয়েটা। নূপুর, তুমি এই ছাউনিতে একটু বসো। আমি এক্ষুনি আসছি। বলে মালির সাথে রিসোর্টের দিকে আগালো। রিসোর্টের গেইটেই ম্যানেজারের সাথে দেখা হয়ে গেলো ওদের। আপনাদের কথাই ভাবছিলাম। আসুন স্যার। বলে বাঁধানো গাছের গুড়িটার উপর বসার ইঙ্গিত করলো ম্যানেজার। কী বলতে চাচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছি না। কোন সমস্যা হয়েছে? কৌতূহলী দৃষ্টি শাহেদের। স্যার সমস্যা আগে থেকেই ছিলো। চাচা আপনিই বলুন, বলল ম্যানেজার। মালি আমতা আমতা করে বলতে শুরু করলো…
গতকাল বিকেলে যে ঘটনা ঘটেছে তা কোন ছেলেপেলে কিংবা মনুষ্য ঘটিত কাজ না। ম্যানেজার সাহেব আপনাকে সাময়িকভাবে দমানোর জন্য কথাগুলো বলেছিলো। কিন্তুু আপনাকে সব খুলে বলা দরকার। খুলে বলা উচিত এ অন্দরমহলের এ দীঘির অভিশপ্ত ইতিহাস…। রিসোর্ট উদ্বোধনের বছরখানেক পর এক নবদম্পতি ঘুরতে আসে এখানে। বেশ দূর থেকে আসায় ১ রাত থাকার কথা ছিলো। রিসোর্টে সবকিছুই দারুণভাবে চলছিলো। হঠাৎ বিকেলের দিকে দূর্বৃত্তদের হামলা হয়। তারা ভেতরে ঢুকে রাহাজানি শুরু করে দেয়। গোলাপ বাগানের ঐ ছাউনিতেই বসে ছিলো সেদিন ঐ দম্পতি। আরো ছয় সাতটি পরিবার ঘুরতে এসেছিলো, দু’টি স্কুল থেকে স্টাডি ট্যুরে এসেছিলো। সবাই যার যার মতো পালাতে শুরু করে। কিন্তুু ঐ দম্পতিকে কিভাবে যেন চোখে পরে যায় ওদের। পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় ওরা। ওদের কাছ থেকে সব কিছু লুট করে নেয়। কিন্তুু মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিতে চাইলে প্রতিবাদ করে ছেলেটা। ফলে ঐ দিঘীর পাড়ে ওকে টেঁনে হিঁচড়ে নিয়ে জবাই করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। অনেক আকুতি মিনতি, চেষ্টা করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারে না মেয়েটা। নিজের শেষ পরিণতির কথা ভেবে জান বাজি রেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে তখন। সামনে কোন পথ খোলা না পেয়ে ওয়াচিং টাওয়ারের সিড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে। সম্ভ্রম রক্ষা করতে হবে। যে করেই হোক বাঁচতে হবে নেকড়েগুলোর স্পর্শ থেকে। পিছু নেয় পশুরদল। প্রায় ৫০ ফিট ওঠার পর পা ফসকে সোজা নিচে পড়ে যায়। পাথুরে জায়গায় পড়ে মাথা ফেটে রক্তপাত হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে আধমরা মেয়েটাকেও দিঘীতে ফেলে দেয় হিংস্র হায়েনারা। কয়েকমূহুর্তের মধ্যেই নিষ্ঠুর এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় নিষ্পাপ দুটি প্রাণ। পশুর দল লুটের টাকাপয়সা নিয়ে বিজয়ের সাথে যাওয়ার পথ ধরে। তারপর? শাহেদ প্রশ্ন করে। তারপর সকালের দিকে মেয়েটার লাশ দিঘীতে ভেসে ওঠে। খুব কষ্টে হতভাগা দুজনের বুকিং ফর্ম এর ইমার্জেন্সি নং এ কল দিয়ে ফ্যামিলিকে ইনফর্ম করা হয়। ওনারা এসে মেয়েটার লাশ নিয়ে যায়। কিন্তুু অতবড় দিঘী থেকে ছেলেটার লাশ উদ্ধার করা যায় নি। ভেসেও ওঠে নি কখনও। মর্মান্তিক একটা ঘটনা! ব্যথিত হয়ে উঠে শাহেদ। জ্বী স্যার। অনেকে বলে এ দিঘীর সাথে আমাদের স্থানীয় নদীর তলসংযোগ আছে। তাই ওনার লাশ হয়তো নদীতে ভেসে গেছে এমন মনে করা হয়। খুবই ট্র্যাজিক! কিন্তুু এ ঘটনার পরে থানা পুলিশ হয় নি? হয়েছিলো স্যার। কিন্তুু উপর মহলের অর্ডারে সমস্ত ফাইল ক্লোজ হয়ে যায়। রিসোর্টের খ্যাতি নষ্ট হবে সেটা ভেবে হয়ত মালিক… বোঝেনই তো…। এটা তো অন্যায় হয়েছে! হুম আর সে অন্যায়ের ঘানিই আজ টানতে হচ্ছে সবাইকে। জানেন স্যার, এ দিঘীতে আগে কোন পদ্ম ফুটতো না। নাম ছিলো সুবর্ণদিঘী। কিন্তুু ঐ ঘটনার পর হঠাৎ করে লালটুকটুকে পদ্ম ফুটতে শুরু করলো! দূর থেকে তাকালে পুরো দিঘীর পানি রক্তরাঙা মনেহয়! এলাকার লোকজন নাম পাল্টে দিলো লালদিঘী। এক মিনিট! তবে কি বলতে চাচ্ছেন দিঘীটায় বিশেষ কোন ব্যাপার আছে? জ্বী স্যার ঠিকই ধরেছেন আপনি। ম্যাডামকে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব চলে যান এখান থেকে। ভীত কণ্ঠ ম্যানেজারের। কিন্তুু আমার জানামতে তো…। শাহেদের কথা শেষ না হতেই একটি নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকার ভেসে আসে বাগানের দিক থেকে। তিনজনই চমকে উঠে দৌড়ে গোলাপ বাগানের দিকে যায়। শাহেদ ছাউনির কাছে ছুটে গিয়ে নূপুরকে খোঁজে। আবার আর্তচিৎকার ভেসে আসে। এবার শাহেদ বুঝতে পারে এটা নূপুরের কণ্ঠস্বর। এবং আসছে দিঘী হতে। দিঘীর পাড়ে এসে থমকে চায় শাহেদ! মাঝ দিঘীতে প্রায় ডুবন্ত অবস্থায় নূপুর। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু হাত দেখা যাচ্ছে দু’টো। হতভম্ব হয়ে শাহেদও ঝাঁপ দিলো দিঘীতে। ভয়ে মালি চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, “আল্লাহ্ রে আইজও দুইটা প্রাণ তুমি নিয়া যাইবা! ও আল্লাহ্ আর কত মরণ দেখমু এই বয়সে…। কিন্তুু জীবনদাতার মহাকরুণায় ও শাহেদের ভালো সাঁতার জানা থাকায় এ দুজনের জীবন প্রদীপ যেন নিভতে নিভতে জ্বলে উঠল! অবাক দৃষ্টি নিয়ে মালি আর ম্যানেজার চেয়ে রইলো দিঘীর দিকে। শাহেদ নূপুরকে কোলে নিয়ে দিঘীর প্রায় বিশটি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে এলো। দ্রুত নুপুরকে রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল…।
বেশ কিছুক্ষণ পর লাল টকটকে দু’টো চোখ মেলে শাহেদের দিকে তাকালো নূপুর। কিছুক্ষণ আগে এক ডাক্তার দেখে কিছু ওষধ দিয়ে গেছেন। নাকে, কানে পানি ঢুকে যাওয়ায় খুব কষ্ট হচ্ছিলো নূপুরের। পানিও খেয়ে ফেলেছিলো অনেক। সবচেয়ে মারাত্মকভাবে পেয়েছে ভয়। এক মূহুর্তের জন্যও শাহেদের হাত ছাড়ছে না ও। শাহেদের মাথায় হাজার প্রশ্ন ঘুরছে তখন। কিন্তুু এখন সেগুলো না বলাই ভালো ভেবে চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর রিসোর্টে বিদ্যুৎ চলে গেলো। ম্যানেজার নক করে শাহেদের কাছে ডজনখানেক মোমবাতি দিয়ে গেলো। বিছানায় ডানকাত হয়ে শুয়ে দু’হাতে শক্তকরে শাহেদের হাত ধরে মোমবাতির কেঁপে কেঁপে ওঠা আলোর দিকে তাকিয়ে আছে নূপুর। শাহেদ বলল, নূপুর তুমি দিঘীর ওদিকে কেন গেছিলা? আমি যাইনি। মূর্তির মত বলে নূপুর। তাহলে? বলবো? হুম বল। প্রথমে খুব চিৎকার আসছিলো ওদিক থেকে। বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলো একটা ছেলে। ভয় পেয়ে যাই আমি। কি করবো বুঝতে না বুঝতেই ওদিকে হাঁটতে থাকি। দিঘীর পানি একটা যায়গায় অস্বাভাবিকভাবে নড়ছিলো। মনে হচ্ছিলো সদ্য কেউ পড়ে গিয়েছে! আর তুমি তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লে না? না না। আমি তো সাঁতার জানি না। আমি দৌড়ে তোমার কাছে আসতে গেলাম। কিন্তুু…। কিন্তুু কি? না থাক বিশ্বাস হবে না তোমার। মন খারাপ দেখাচ্ছে ওর। ১০০% বিশ্বাস হবে। তুমি বলো। আমার মনে হলো অনেক জোরে কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে দিঘীতে ফেলেদিল, বলে কেঁদে ফেলল নূপুর। শাহেদের খারাপ লাগে। সাথে আতঙ্ক! ওর কান্না থামিয়ে ওষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে বাইরে আসে ও। পাশের রুমেই ম্যানেজার থাকে। শাহেদ ওর রুমে এসে দেখলো মালি আর ম্যানেজার একসাথে বসে আছে। ওনাদের নিজের রুমে ডেকে নূপুরকে আরেকবার দেখে এসে ডাইনিং রুমের চেয়ার টেনে তিনজনই বসলো। আমার মনেহয় ওকে একা রাখা ঠিক হবে না। তাই আপনাদের এখানেই ডাকলাম। মালি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো, বাবু, মাফ কইরা দেন মোদের। শাহেদ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। স্যার, ম্যাডাম এখন কেমন? ম্যানেজারের চোখে উদ্বিগ্নতা। হুম। এখন একটু ভালো, বলল শাহেদ। কিছু বলছিলেন আপনারা। শেষ করুন…।
মালি আবারও বলতে শুরু করে, স্যার, ঐ খুন দু’টোর পরে রিসোর্টে লোকজন আসা একদম কমে যায়। বছর খানেক আগে একেবারেই জনশূন্য হয়ে পড়ে আরো কিছু ঘটনার জন্য। কী ঘটনা? ঐ ঘটনার পরে দুটি মেয়ে দিঘীতে ডুবে মারা গিয়েছে। ঐ দিঘীতে কেউ ডুবলে আর বাঁচে না। আত্মা প্রতিশোধ নেয়। শাহেদ একটু চমকে উঠে! কিন্তুু সেটা ওদের দুজনকে বুঝতে না দিয়ে বলে, দেখুন, আত্মা বলতে কিছু নেই। অসাবধানতার জন্যও তো হতে পারে! আল্লাহ্ জানেন। তবে দুজনের মৃত্যুর আগেই একইরকম কিছু ঘটেছে। যেমন? দিঘীর পাড়ে মাছ লাফিয়ে ওঠে আর ঠিক তার পরদিনই তারা দিঘিতে পড়ে মারা যায়। ২য় জন সাঁতরে পাড়ে এলেও পরে প্রচন্ড জ্বরে মারা যায়। শাহেদ কিছু বলতে পারছে না। গলার কাছে শব্দগুলো কেমন থেমে যাচ্ছে…।
এ দুটি ঘটনার পরই রিসোর্ট একেবারে বন্ধ হবার যোগাড় হয়। কিন্তুু মালিক খুব রাগী ও জিদি মানুষ। এ সব ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রিসোর্টে বিজনেস চালিয়ে যেতে চায়। কেউ এখানে কাজও করতে চায় না। কিন্তুু ক্ষমতাধর জন্য আমাদের মত অসহায় কাজের লোক খুঁজতে তাদের অসুবিধা হয় না। স্যার আপনারা আসার আগে আমাদের হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে পূর্বের ঘটনার কিছু ঘূণাক্ষরেও যেন না বলি। আমাদের ভুল বুঝবেন না প্লিজ। অসহায় কণ্ঠ ম্যানেজারের। কিছুই বুঝতে পারছি না। গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মাথায়। তবুও ব্যাপারটা আরো আগেই আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো আপনাদের। একটু রেগে দ্রুত বলে ফেলে রাশেদ কথাগুলো। মাইয়াডা ঐ টাওয়ারের নিচে আইজও কান্দে। প্রতি রাইতেই কান্দে। আমার একটা মাইয়া থাকলে হয়ত এরাম বয়সই হইতো। আমি বাঁচাইতে পারিনি বাবু…। মালি হঠাৎ কেঁদে উঠলো। হঠাৎ শাহেদের মনে পড়ল নূপুর অনেকক্ষণ একা ঘুমাচ্ছে। একটু দেখে আসা দরকার ভেবে বেড রুমের দরজার পর্দা সরিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো! পর্দার ওপাশে নূপুর চুপকরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো রক্তলাল! নূপুর শাহেদকে বলে, ওনারা যা বললো তা কি সত্যি? আরে নাহ্। তুমি এদিকে এসো তো। বলে নূপরের হাত ধরে শাহেদ। কিন্তুু একি! ওর গা এত গরম কেন? ভেতরটা ধক্ করে ওঠে শাহেদের। ওর কপালে হাত রেখে জ্বরের পরিমাপ বোঝার চেষ্টা করে। পুড়ে যাচ্ছে কপালটা। শাহেদ ওকে বিছানায় এনে রাতের খাবার আর ওষধ খাইয়ে দিয়ে জলপটি দিতে থাকে। গভীর রাতে অনেক জ্বরের ঘোরে নূপুর প্রলাপ বকতে শুরু করে…। শাহেদ, টেবিলে রাখা পদ্মগুলো কই? ফেলে দিয়েছি। কোন সাহসে? পরে হবে সেসব কথা। নূপুর, তুমি খুব অসুস্থ। এখন ঘুমাও। মিথ্যে কথা। আমি অসুস্থ না। উফ্ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি দিঘীর কাছে যাবো। দুঃশ্চিন্তায়, ভয়ে শাহেদের অস্থির লাগতে থাকে। এমন করে কেনো নূপুর? জ্বর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে! শাহেদ বিছানায় বসে নূপুরের মাথাটা বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। নূপুরকে ছাড়া বাঁচবে না ও। কোনভাবেই না। মরতে যদি হয় একসাথেই মরবে। বাঁচলেও একসাথে। সিক্ত নয়নে করুনাময়কে একমনে ডাকতে থাকলো ও…। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শাহেদ কাচের জানালায় কারো ছায়া দেখলো। কেমন দ্রুত পার হয়ে গেলো! জানালা থেকে চোখ সরাতেই দেখলো সামনের সিঙ্গেল সোফাতে রক্তমাখা বিভৎস চেহারার এক পুরুষ বসে আছে। এত ভয়ংকর যে শাহেদ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না। বিভৎস চেহারার প্রণীটির পুরো শরীর ভেজা। গায়ে কালো পোশাক লেপ্টে আছে। ঘর জুড়ে কাঁদা মাটি ও শ্যাওলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। শাহেদ বিবর্ণ চেহারাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো, কে? কে ওখানে? রক্তমাখা ভয়ংকর চেহারা এবার কথা বলতে শুরু করলো। এ রিসোর্টের সব পাপীদের মেরে ফেলবো। হাহাহাহা। প্রতিশোধ নেবো নিরপরাধ দুটি প্রাণ নাশের। যেভাবে আমাদের দু’জনকে মেরে ফেলা হয়েছিল…। সবগুলোকে ডুবিয়ে মারবো। বলতে বলতে বিভৎস চেহারাটা হঠাৎ কেমন মলিন হয়ে এলো। ফুটে উঠলো সুন্দরমতো এক ছেলের চেহারা! নম্র হয়ে ধরা গলায় বলতে শুরু করলো ছেলেটি, আমি আর আমার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী নিশা একসাথে এই রিসোর্টে উঠি। প্ল্যান ছিলো একরাত এখানে থেকে ঢাকা চলে যাওয়ার। ইশ! পরদিন সকালে আমার নতুন চাকুরীতে জয়েন করার কথা ছিলো! নিরাপত্তার জন্য আমাদের কাছে বেশ কিছু টাকা ও কয়েক ভরি গহনা ছিলো। গহনাগুলো নিশার মা ওর বিয়ের জন্য গড়েছিলো। পালিয়ে আসার সময় সেগুলো সাথে এনেছিলো ও। এগুলোই যে একসময় অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভাবতে পারিনি। কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় ব্যাপারটা রিসোর্টের মালিক। লোভী পাপীটা তার দুই বন্ধুকে নিয়ে আক্রমণ করে বসে। কেড়ে নেয় সব কিছু। প্রতিবাদ করিনি। জানি বিফলে যেত। কিন্তুু ওরা ক্ষ্যান্ত হলো না, হাত বাড়ালো নিশার দিকে। তখন প্রচন্ড রাগে পাল্টা আক্রমণ করলাম। যার ফল আমাদের আজকের এই অবস্থা । বলা শেষ করে হাতে চোখ মুছলো ছেলেটা। এরপর হঠাৎ আবার সে বিভৎস চেহারায় রুপান্তর হলো। ভয়ংকর জ্বলজ্বলে রক্তচক্ষু তুলে বলতে শুরু করলো, “মেরেছি! একটা বাদে সবগুলোকেই শেষ করেছি হাহাহা! কী শুনেছিস? দু’টো মেয়ে মরেছে দিঘীতে? উঁহু। সাথে দু’টোর খরিদ্দারও ছিলো। ওরা রিসোর্টের মালিক সোহেল আলীর কুকর্মের দুই বন্ধু। কুপেশার দুজনের সাথে এসেছিলো রিসোর্টে ফূর্তি করতে। একে একে শেষ করে দিয়েছি। সোহেলের ঐ দুই খুনি বন্ধুর দাফন এই দিঘীতেই হয়েছে। লাশ না পাওয়ায় বুঝতে পারেনি কেউ। জেনেছে নিঁখোজ! হাহাহা। কিন্তুু যার জন্য এত প্ল্যান সে বুঝেগেছে হয়ত…। চতুর হায়েনা কি না! ভুলেও এদিকে আসে না। কিন্তুু কতদিন এভাবে! ঐ কুকুরের মৃত্যু এই দিঘীতেই আছে। এবং তাই হবে। হুম ঠিকই ধরেছিস। সেদিন দূর্বৃত্ত নামের ঐ ডাকাত দলের সর্দার এই রিসোর্টের মালিকই ছিলো। তোর সাথে ওর চেহারার কিছুটা মিল থাকায় বিরাট এক ভুল হতে যাচ্ছিলো। শুধরে দিয়েছি। অনেক তামাশা দেখেছিস। এবার নীড়ের পাখি নীড়ে ফিরে যা…। কথাগুলো প্রতিধ্বনিত করে মিলিয়ে গেলো বিভৎস মূর্তিটা।
শাহেদ চোখ বন্ধ করে ফেললো। এক মনে স্রষ্টাকে ডাকতে ডাকতে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। কী হচ্ছে চারপাশে এসব? নূপুর ঘুমিয়ে আছে। কিন্তুু ওর আর ঘুম এলো না। কাদা, মাটি, শ্যাওলা আর আঁষটের বিশ্রী গন্ধ এখনও নাকে লাগছে…।
ঘণ্টা দু’য়েক পর সোনালী সূর্যের কাঁচা রশ্মি ঘরে প্রবেশ করার পর পরই শাহেদ উঠে পরলো। গতরাতে যা ঘটেছে তারপরে আর এক মূহুর্তও এ রিসোর্টে নয়। পরিদন সকালেই বাড়ির পথ ধরলো ওরা।

দু’মাস পরের ঘটনা:
হঠাৎ একটা নিউজ নিয়ে মিডিয়ায় খুব মাতামাতি দেখা যাচ্ছে। বিস্তারিত জানতে খবর দেখতে বসলো শাহেদ আর নূপুর। খবরের বিষয়, দেশের পুরোনো জমিদার বাড়িতে বানানো সেই একমাত্র সর্ববৃহৎ নতুন রিসোর্টটি। রিসোর্টের লালদিঘীতে ডুবে মারা গিয়েছে রিসোর্টের মালিক…।

(Visited 13 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *