বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক জীবনবেদ – মজিদ মাহমুদ

শেয়ার করুন

মজিদ মাহমুদঃ বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার জীবন নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। বাংলা ভাষার জীবন মানেই বাঙালির জীবন। বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালি নেই। হাজার বছর ধরে বাংলাভাষী জনপদের মধ্যে বসবাস সত্ত্বেও কারো প্রধান ভাষা যদি বাংলা না হয় তাহলে তিনি বা তারা কখনো বাঙালি নন। আবার পৃথিবীর যে প্রান্তেই বসবাস করুন না কেন, কারো প্রধান ভাষা যদি বাংলা হয়, চিন্তার কাঠামো যদি বাংলাকে আশ্রয় করে পল্লবিত হয় তাহলে তিনি বাঙালি। আর এ ক্ষেত্রে মাতৃভাষার অর্থ প্রধান ভাষা। তবে যারা মাতৃভাষা ত্যাগ করে তারা সে ভাষাগোষ্ঠীর বর্তমান দাবিদার থাকতে পারেন না।
জন্মসূত্রে যেমন বাঙালি তেমন বাংলাভাষা গ্রহণ করার মধ্য দিয়েও কালক্রমে বাঙালি হওয়া সম্ভব। আজ আমরা যাদের বাঙালি বলে জানিÑ একদিন তাদের কারু ভাষাই বাংলা ছিল না। এমনকি ভাষা হিসেবেও বাংলার অস্তিত্ব ছিল না। আর যখন বাংলা ছিল না তখন বাঙালিও ছিল না। তবে এ জনপদের আদিম অধিবাসী, যাদের আশ্রয় করে বহু পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এ ভাষাটি নির্মিত হয়েছিল, তারা নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির আদিপুরুষ।
বাঙালির ইতিহাস কি খুব প্রাচীন? বাংলা ভাষার ইতিহাস বড়জোর টেনেটুনে হাজার দেড়েক বছর নেয়া সম্ভব। সুতরাং কুলীন ভেবে বাঙালির শ্লাঘা বোধ করার কারণ নেই। প্রাচীন যে অর্বাচীনের চেয়ে সব সময় শ্রেয় তেমন ভাববারও কিছু নেই। তবু বাংলা ভাষা হিসেবে সংগঠিত হওয়ার অনেক আগেই পৃথিবীর বহু প্রান্তে ভাষা এবং ভাষাকেন্দ্রিক সভ্যতা নিয়ে গর্ব করার বহু উপাদান তৈরি হয়ে গেছে। বাংলা ভাষার আবির্ভাবেরও দু হাজার বছর আগে যে সব মহাকাব্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে, যে সব জাতি ও সভ্যতার কথা আমরা জানতে পেরেছি, তাতে ভাষা হিসেবে বাংলা তাদের সুদূর দৌহিত্রী ছাড়া কিছু নয়। এমনকি এই ভারতবর্ষে আর্যরা আসার আগে কিংবা অনেক পরেও বাংলার অস্তিত্ব ছিল না। ভারতবর্ষের সংস্কৃতসহ প্রধান ভাষার বিবর্তন ও প্রজননের মধ্য দিয়ে যেমন বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে, তেমনি বিশ্বের বহু প্রান্তরের ভাষা ও শব্দ সহযোগে বাংলা ভাষার শরীর পুষ্ট হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, বাংলা ভাষা কীভাবে সৃষ্টি হলো? বাংলা ভাষা সৃষ্টির রহস্যের মধ্যেই এ ভাষার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আর এর সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ভাষা কোনো অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। বাংলা ভাষার সংগঠনের আগে বর্তমান বাংলাভাষী জনপদে
বিভিন্ন জাতি শ্রেণী বংশ ও গোষ্ঠীর লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের বংশগত উৎপত্তি ধর্ম সংস্কৃতি ও রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এদের প্রত্যেকেরই আলাদা পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য ছিল। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ যখন বিভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতি নিয়ে পরস্পর কাছাকাছি বসবাস করতে শুরু করে তখন নিজেদের যোগাযোগের প্রয়োজনে ভাষার আদান-প্রদান শুরু হয় এবং কেউই তাদের নিজেদের ভাষার কুলীনত্ব রক্ষা করতে পারে না। তাদের ভাষার সিনট্যাক্স ও সিমানটিক স্ট্রাকচার নতুন করে গড়ে উঠতে শুরু করে, যা পূর্বে কোনো মানবগোষ্ঠীর সরাসরি ভাষা ছিল না। এ পর্যায়ে সে অঞ্চলের বাসিন্দাদের স্থায়ী বসবাস ও তাদের বংশধরদের মধ্যে সেই নবগঠিত ভাষা ও শব্দের বিকৃতায়ন কালক্রমে ভাষায় পরিণত হয়। আমরা দেখেছি, আফ্রিকার বহু দেশে, যেখানে ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশের কারণে কিংবা ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশ ও স্প্যানিশদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দাস এনে জড়ো করা হয়েছিল। সেখানে বহু নতুন ভাষা সৃষ্টির হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে যোগাযোগের খাতিরে ভাষার যে পরিবর্তিত অবস্থা সৃষ্টি করা হয় তাকে পিজিন এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশধররা যে নতুন ভাষার উত্তরাধিকার হয়ে ওঠে তাকে ক্রিয়ল বলে। এখনো আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ক্রিয়ল।
বাংলাভাষা কারা সৃষ্টি করেছিল? বাঙালির আদিপুরুষই বা কারা? এ নিয়ে বিস্তর বিরোধ থাকলেও এটা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, উত্তর ইউরোপ থেকে আগত আর্যরা বাঙালির পূর্বপুরুষ নয়Ñ বাঙালির পূর্বপুরুষ অস্ট্রিক কিংবা তারও পরে মঙ্গলয়েড। অস্ট্রিক বা নিষাদ জাতিÑ বাঙালির পূর্বপুরুষÑ যে ভাষায় কথা বলতো তা কিন্তু বর্তমান বাংলা ভাষায় বড় কোনো রূপ নিতে পারেনি। তবে মুন্ডারি, সাঁওতালি, ও কুরকু ভাষীদের মধ্যে তার সাক্ষাৎ পরিচয় পাওয়া যায়। এই ভাষাভাষীর অধিকাংশ লোক, যারা বর্তমান সভ্যতার বাইরে বনে জঙ্গলে কিংবা পাহাড়ে বসবাস করছে, তারাই কেবল নিজেদের আদিম অস্তিত্বের কিছুটা বজায় রাখতে পেরেছে। বাকিদের অনেকেই আজকের বাঙালির পরিচয়ে বসবাস করছে। তবে এরা সব বাঙালির আদিপুরুষ নয়Ñএরা কেবল এ জনপদের বাসিন্দা। বাঙালির কোনো অবিমিশ্র আদিপুরুষ নেই। অস্ট্রিকরাই এদেশে কৃষি সভ্যতা গড়ে তোলে এবং বাংলা ভাষার ভ্রƒ“ণ-জাইগোটও তাদের হাতে গড়ে ওঠে। এর পরে মঙ্গলয়েড গোত্রের দ্রাবিড়রা এদেশে আসে। এদের ভাষা-সংস্কৃতি নিষাদদের চেয়ে কিছুটা উন্নততর ছিল। এরা নগর সভ্যতার গোড়াপত্তন করে বলে জানা যায়। নিষাদ-দ্রাবিড়ের পরে আসে কিরাত জাতি এবং এই পর্যায়ের সবশেষে আসে আর্যভাষী জাতি। ভাষা ও সভ্যতায় আর্যভাষীরা বাঙালির সর্বপূর্ব আদিবাসীদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ভাষার ক্ষেত্রে একক প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ ছিল, আর্যদের বিবর্তিত ভাষা সংস্কৃত কখনো সাধারণ মানুষের মৌখিক ভাষা ছিল না। মুখের ভাষার বাইরে থেকে ভাষার সৃষ্টি ও বিবর্তনে একক ভূমিকা রাখা অসম্ভব। স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন বলতে চেয়েছেন মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উদ্ভব। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও এ মতের সমর্থক। তবে শহীদুল্লাহ সাহেব বলেছেন গৌড়ি প্রাকৃত থেকে এ ভাষার উৎপত্তি।
এ ভাষা যতদিন থেকেই উৎপন্ন হোক না কেন, আমরা কিন্তু চর্যাপদের আগে এ ভাষার তেমন কোনো নিদর্শন পাই না। তাছাড়া চর্যাপদকালে ভারতবর্ষের বিকাশমান অন্যান্য ভাষার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য ছিল, বিশেষ করে হিন্দি ও উড়িয়ার সঙ্গে। যে কারণে চর্যায় বাংলাভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে বেশ সময় লেগেছে। তবে পণ্ডিতরা এই সব ভাষার বিভক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে অন্য ভাষার অধিকার নাকচ করে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে চর্যার যৎসামান্য নিদর্শন প্রায় চারশ বছর ধরে বাংলা ভাষার বয়সকে দীর্ঘায়িত করে দিয়েছে। আর এসবই ছিল ভাষার সৃষ্টি ও বিবর্তন প্রক্রিয়ার অংশ।
ড. আহমদ শরীফের বাঙালির পরিচয়ের অকাট বাস্তবতার কিছুটা উদ্ধার করে মূল আলোচনায় ফিরে যাব : ‘বাঙালি চিরকাল বিদেশী শাসিতÑবিজাতি শাসিত। বাংলা দেশের যে সব ধর্ম সেগুলোও বিদেশ থেকে আগতÑ হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম বিদেশ থেকে আসা উত্তর ভারত থেকে আসা, আরব থেকে আসা এবং হিব্র“ অঞ্চল থেকে আসে খ্রিস্টান ধর্ম। আমাদের ভাষাও হচ্ছে উত্তর ভারতীয়। কাজেই বাঙালির যে গৌরব এবং গর্ব আমরা করছি, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালির গৌরবÑ কোনটাই বাঙালির কীর্তি বা কৃতী নয়…। বাঙালির ইতিহাস পূর্ণ অবাঙালি বহিরাগতের বিবরণ দিয়ে।’ এসব অবাঙালিই একদিন বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং বাঙালি জাতির সৃষ্টি করেছে। তবে ভাষা বহতা নদীর মতো Ñ প্রবাহমান। রাতারাতি ভাষা পরিবর্তন কিংবা সৃষ্টি সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত ভাষার শব্দরাজির মধ্যে, ভাষার গঠন ও অর্থের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন ও রূপান্তর ঘটে চলে। একটি মাত্র প্রজন্মে তার সবকিছু প্রবলভাবে দৃশ্যযোগ্য নাও হতে পারে। তবে যে ভাষা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হতে পারে না; গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষমতা যে ভাষায় কম, সে ভাষা কালক্রমে বদ্ধ নদীর মতো শুকিয়ে যায়। তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, ভাষা কখনো নিজে নিজে সৃষ্টি হয় না এবং নিজে নিজে কোনো ভাষা পরিবর্তিত কিংবা মৃত হয়ে যায় না। ভাষাও অস্তিত্বের মতো একটি সহযোগী সত্তাÑ কেউ ব্যবহার না করলে ভাষার অস্তিত্ব গঠন ও টিকে থাকা সম্ভব নয়। মানুষ ইচ্ছে করলেই তার ভাষা পরিবর্তন করতে পারে। এটি তার সহজাত ক্ষমতা। আমরা আজকে যে ভাষাকে বাংলা বলে জানি, এবং গর্ব ও মান্য করি, সে ভাষা একদিনে নিজে নিজে তৈরি হয়নি। এ ভাষার অনেকখানিই এসেছে অন্য জাতির ভাষা থেকে। আজ আর আমরা আলাদা করে দেখতে পারি না কোনটি আমাদের আর কোনটি অন্যদের। আর এসব উপাদান আলাদা করতে থাকলে আজকের বাংলা ভাষাকে আমরা আমাদের বলে চিনতে পারব না। বহু ভাষা ও জাতিধর্মের মানুষের মিশ্রণ ও বাইরের জগতের প্রবল অভিঘাতের ফলে বাংলা এ অঞ্চলের প্রধান ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসেবে এ ভাষার অবস্থান কয়েক হাজার ভাষার শীর্ষ পঞ্চমে।
বাংলা ভাষার বিস্তৃত হবার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। তা না হলে ভারতবর্ষের এই বিশাল অংশে অল্পদিনের মধ্যে সর্বাধিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারত না। কেবল এই উপমহাদেশে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলা ছাড়া এত শক্তিশালী ও বহুজন ব্যবহৃত ভাষা নেই। প্রাচীনকালের রাঢ়, বিদেহ, সুহ্ম, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সমতট বিভিন্ন জনপদ অতিক্রম করে এ ভাষা ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম ত্রিপুরা ঝাড়খন্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষা প্রবল আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
ভাষা গড়ে উঠবার জন্য ভাষা ব্যবহারকারীদের কেবল মানসিক শক্তি থাকলেই চলে না, অর্থ-রাজনৈতিক শক্তিতেও বলীয়ান হতে হয়। কাছাকাছি জনগণের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে ভাষা যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমন রাজাকে কেন্দ্র করেও ভাষা শক্তি ও আধিপত্য বিস্তার করেছে। মধ্যযুগে আমরা তা দেখেছি, বর্তমান যুগেও দেখছি। তবে বর্তমান সময়ে এই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র পরিবর্তন হয়েছে নিঃসন্দেহে। ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম। এই যোগাযোগ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের চিন্তা ও উপলব্ধি প্রকাশ এবং বস্তুর সঙ্গে ভাষার প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। বর্তমানে আকাশ মিডিয়া ও শারীরিক প্রক্ষেপণ বিপ্লবের ফলে ভাষার কুলীনতা রক্ষা করা যাচ্ছে না। ভাষা আপনাতেই তার চরিত্র পরিবর্তন করে নিচ্ছে।
ভাষাকে কেন্দ্র করেই কেবল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। তাই বলে জাতি আর রাষ্ট্র এক নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদিও প্রধানত বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে, তবু একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভাষার ধারণায় নিজেদের একীভূত করেনি। কিংবা তাদের জন্য সেই সময় এবং সুযোগটুকু এখনো সৃষ্টি হয়নি। তাছাড়া কেবল ভাষাকে কেন্দ্র করে, বাঙালি জাতির কেন্দ্র বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে বললে ভাষার বাইরে সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষিত হয় না। তবে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও ঐক্যগঠনে ভাষার ভূমিকা ব্যাপক। রাষ্ট্রের চরম ঐক্য গঠনের জন্য দেশে একটিমাত্র ভাষার প্রয়োজন। অন্য ভাষার অধিকার স্বীকৃত করা রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য মঙ্গল নয়। দেশের মধ্যে অন্য ভাষাকে ধ্বংস ও ক্ষয়িষ্ণু করে রাজার ভাষাকে চাপিয়ে দেয়া কিংবা প্রতিষ্ঠা করার উদাহরণ অল্প নেই। স্কটল্যান্ডের গেরিক এবং ওয়েলসের ওয়েলশ-ভাষাকে দুর্বল ও নিঃশেষের পথে এগিয়ে দিয়েই ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ জাতির একতা রক্ষা করা হয়েছে। ফ্রান্স প্রভাঁসাল ও ব্রেঁত ভাষাকে হটিয়ে দিয়ে ফরাসি ভাষা ও জাতির একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। রাশিয়াও তার প্রান্তিক ভাষাগুলোকে ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। তবে রাশিয়ার রাষ্ট্রশক্তি খর্ব হওয়াতে পোলীয়, লিথুনীয়, লেট, এস্তেনীয়, ফিন ও আর্মেনীয় ভাষা কোনোমতে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃত বিচারে মানুষের অস্তিত্ব ভাষা ও ধর্মকেন্দ্রিক। তাই আমরা ইতিহাসের কালে দেখতে পেয়েছি দুর্বল জাতির ওপর সবল জাতি এ দুটো জিনিস চাপিয়ে দিয়ে তাদের স্বকীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করতে চেয়েছে। আর যে সবল জাতি এ দুটি বিষয় দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছে তারাই তাদের রাষ্ট্র ও জাতির আধিপত্য ঐক্য বেশি দিন ধরে রাখতে পেরেছে। ভাষার এই আগ্রাসী ক্ষমতা অতীতের চেয়ে বর্তমানে অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রশ্ন, ভাষার এই ঔপনিবেশিক চরিত্রের হাত থেকে আমরা কীভাবে আমাদের ভাষাকে এবং ভাষার কুমারীত্ব রক্ষা করে চলব? এ কথা সত্য ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা উর্দুভাষার অবৈধ হস্তক্ষেপকে হটিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন পাকিস্তান আমলে ৫৪.৬ ভাগ মানুষের ভাষাকে মর্যাদা না দিয়ে মাত্র ৬.০ ভাগ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার চক্রান্ত রোখা সম্ভব হলেও আজকে কালের প্রয়োজনে বাংলা ভাষা দ্রুত তার রূপ পরিবর্তন করছে। আমরা কাছ থেকে খুব দেখতে পাচ্ছি না।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সাময়িকীর সম্পাদকীয় মন্তব্য কিছুটা উদ্ধার করা যেতে পারে Ñ ‘বাইচান্সে এই বহির উত্তুঙ্গ প্রাণে ভুল ভাবে ছোঁয়া লাগে একদম শক্ড হইয়া যাবে। কইবেন আরে। লোকাল জিনিসে এত চার্জ! নেটিভ পুঁজিতে (বুদ্ধিবৃত্তিক) এত ধক্! ভিতরের কথা বাদ দেন। জাস্ট এই বইটার বাইরের শরীরে কি টান টান হইয়া নাই এই সময় স্পর্শ কাতর স্নায়ুগুলো? বক্তব্যে এলান নাই ভাষা-রাজনীতির আগ্রাসী, বেপরোয়া-মুখর পোলিমিক? আর, এই বহি যদি ইনফ্যান্ট-টেরিবলের মত উচ্চকিত টেন্ডেন্সি নিয়া সপ্রতিভ হয়, অ্যাকাডেমিক বাগ্মীর পেশাগত নৈপুণ্যর পাশ কাটায় চলে তবে সেইটা মন্থর ও বাঁধিবৎ চিন্তারে, প্রতিষ্ঠানগুলারে আক্রমণ করার জন্য।’ এতে বর্তমান প্রচলিত বাংলা ভাষার স্বাভাবিকতার ওপরে যথেষ্ট রকম বলৎকার করা হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। এবং ওপরের উদাহরণটি আমাদের ভাবিত করে। কেবল ভাবিত নয় আমাদের উদ্বিগ্নও করে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মুন্সিরা যে মোটিভ নিয়ে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশের পথকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, দুশ বছর পরে এটি কি তার সম্প্রারিত রূপ? তানা হলে মাত্র ৬ পঙ্ক্তি লেখার মধ্যে এমন কঠিন মাপের ১২টি ইংরেজি কীভাবে ঢুকলো? ‘ইনফ্যান্ট টেরিবলে’র মতো ইংরেজি শব্দ তো গ্রহণ করার মতো এ ভাষা এখনো প্রস্তুত হয়নি। এ ধরনের শব্দ ও বাক্য গঠনে ভাষার স্বাস্থ্যহানির কারণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এ বাক্যের রচয়িতারা হয়তো ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতদের মতো শিক্ষিত। একটি পরিবর্তনের ক্ষমতা হয়তো তাদেরও আছে। তবে সে থাকার পিছনে একটি উদ্দেশ্যবাদী দীর্ঘমেয়াদি পরাশক্তির সমর্থন থাকা দরকার। চিন্তার জগতে নব্য উপনিবেশবাদের যে তাত্ত্বিক প্যারাডাইম গঠিত হচ্ছেÑ এখানে তা ভাববার অবকাশ রয়েছে।
আসলে কোনটিকে আমরা মান্যভাষা করে তুলতে চাই? এ ক্ষেত্রে একটি বিতর্ক মীমাংসা হয়ে যাওয়া ভালো। প্রায়ই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার মান্যরূপ কেমন হবে? ভাষা যেভাবে বিকশিত হয়েছে, আমরা সেই পথে এগিয়ে যাবো না ফোর্ট উইলয়াম কলেজের মুন্সিদের সংস্কৃতঘেঁষা কৃত্রিম ভাষাটিকে গ্রহণ করবো? প্রকৃতপক্ষে এ বিতর্ক করার সময় এখন আর নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের ভাষা যতই কৃত্রিম হোক, যতই সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে আনা হোক, বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান গদ্যের মহাধারার সূত্রপাত তারাই করেছেন। আজ বাংলা ভাষার গদ্যের ধারণ ও সহ্যক্ষমতা নিয়ে আর কোনো দ্বিমত নেই। ভাষা বলতে আমরা এখানে যা নিয়ে কথা বলছিÑ তা আসলে একই ভাষার রকমফের, উচ্চারণ বিধি ও শব্দ নিয়ে অর্থাৎ যাকে ডালেক্ট বা ভাষার আঞ্চলিক রূপ বলা হয়। যেমন নোয়াখালীর বাংলা, সিলেট ও চট্টগ্রামের বাংলা, যার উচ্চারণ ও শব্দগত ব্যাপক পার্থক্য আছে। কিন্তু তাই বলে এই নয়Ñ একটি অঞ্চলের ভাষা খারাপ বা ভালো। ভাষার খারাপ-ভালো নির্ভর করে মূলত তার ব্যবহারকারীদের ক্ষমতার ওপর। যেমন চলতি ভাষার ক্ষেত্রে কলকাতার শান্তিপুরের ভাষাটিকে অনেকখানি গ্রহণ করা হয়েছিল। এর প্রধান কারণ কলকাতাকেন্দ্রিক বাবু শ্রেণীর বিকাশ। আমরা প্রকৃতপক্ষে যে ভাষাটিকে ভাষার সহজাত রূপ বলছি সেটিও সহজাত কিংবা সাধারণ মানুষের মুখনিঃসৃত নয়। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণীর যোগাযোগের দ্বারা স্বীকৃত ভাষাকেই আমরা গ্রহণ করেছি। এদেশের মানুষের সঙ্গে আরব বণিকদের যোগাযোগ এবং এদেশে মুসলমান আসার সুবাদে ও এদেশের অধিকাংশ মানুষের মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করায় আরবির একটি প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ঠিকই কিন্তু মোগলদের শাসন সুবাদে তাদের, উন্নত সাহিত্যের স্পর্শে আরবির চেয়ে ফার্সি ভাষার অধিক আধিপত্য এ ভাষায় দেখা যায়।
ভাষার সঙ্গে একটি রাজনীতি কালে কালে চলে এসেছে। ভাষা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত ও শাসক শ্রেণী সব সময় ঘোট পাকিয়েছে। ভাষার অধিকার সবার জন্য সব সময় সব ভাষায় সমান ছিল না। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি একইভাবে সত্য। সংস্কৃত ভাষা চর্চা করার ক্ষমতা যেমন সাধারণ মানুষের ছিল না, তেমন পাল শাসনে চর্যার আদলে সাহিত্যচর্চা করেছেন বৌদ্ধভিক্ষুরা। আবার মধ্যযুগের বাংলা ভাষা সাহিত্যের পরিপূরকতা দান করেছেন ভিন্নভাষী মুসলিম শাসকরা। আর ইংরেজ আসার সঙ্গে সঙ্গে, তাদের শাসন সম্প্রসারিত ও টেকসই করতে এবং যিশুর প্রেমের বার্তা এদেশের অখ্রিস্টানদের কাছে পৌঁছে দিতে দেশীয় ভাষার প্রয়োজন হয়েছিল খুব বেশি। কিন্তু ভাষাটি যাতে পূর্ববর্তী শাসকদের না হয় সে ব্যাপারে উইলিয়াম কেরি ও তার পৃষ্ঠপোষকদের খুব সতর্ক থাকতে হয়েছে। ফলে সংস্কৃত পণ্ডিত রামরাম বসুর ফারসিয়ানা বাংলা তাদের পছন্দ ছিল না। সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা গদ্য গড়ে তোলাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। এ জন্য তাদের দোষ দেয়া যায় না। রাষ্ট্র মাৎস্যন্যায় থেকে রক্ষার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত এবং প্রায় সময় তাদের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করেছে। কারণ ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি মানুষকে জোট বাঁধতে, একত্র করতে সহায়তা করে যা শাসকের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু আমরা যারা ভাষার সুবিধাভোগী তারা ভাষার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি; যা কোনো না কোনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করে তোলে। তবে এটা ঠিক নিজের ভাষায় প্রবেশ অধিকার অন্য ভাষার চেয়ে অপেক্ষাকৃত সহজে পাওয়া সম্ভব।
এটা সত্য যে, বিশেষ করে ঢাকার জীবনে, ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটি মৌখিক ভাষার বিকাশ ঘটছেÑ চলতি পথে একটু কান পাতলেই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। যদিও প্রবীণদের কাছে তা ব্যান্ডের গানের মতো বেসুরো ঠেকবে এবং রীতিমত স্ল্যাং ও অমার্জিত মনে হবে তবু এই বিকাশ অনিবার্য। যেভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু ডাইলেকটের মানুষ রাজধানীতে জড়ো হচ্ছে তাতে মৌখিক ভাষার একটি পরিবর্তন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সূচিত হয়েছে। তবে সে ভাষা এখন পর্যন্ত কেবলই মৌখিক। সে ভাষার লেখ্যরূপ কিংবা সার্বজনীন কল্পনা এখনো অদূর কালের বাইরে। আবার এ ভাষাকে মান্যভাষার রূপ দিতে গেলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা-বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা হবে না তা হলপ করে বলা যায় না। অন্যদিকে দেশের সব অঞ্চলের ভাষাকে একীভূত করে একটি ভাষায় রূপ দেয়াও সম্ভব নয়। প্রায় সব ভাষার ক্ষেত্রেই একটি মান্য লেখ্যরূপ রয়েছে। ভাষার লেখ্যরূপ আর মৌখিক রূপ কখনো পুরোপুরি এক হওয়া সম্ভব নয়। আর কথা বলার সময় বইয়ের ভাষায় কোনো ভাষার লোকই কথা বলেন না। লেখা যেমন শিখতে হয়, ভাষার লেখ্যরূপটিও তেমন শিখতে হয়। ভাষার অপ্রধান প্রান্তিক ভেদকে টেনে এনে আলাদা ভাষার দাবিকে জোরদার করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে ভাষার মধ্যে যে পার্থক্য নেই তা নয়। সুনীতিবাবুর অভিমত, ‘ভাষা-ভিত্তিক বিচারে কতকগুলি বাঙ্গালা ধ্বনির উচ্চারণ ধরিয়া উত্তর বঙ্গের কথ্য ভাষাগুলিকে পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষার শামিল বা তাহার সহিত সম্পৃক্ত করিয়া ধরা হইতো। তবে চ-বর্গের বর্ণগুলির উচ্চারণ হ-কার ও মহাপ্রাণ ঘোষধ্বনি ‘ঘ ঝ ঢ ধ ভ’ এই বর্ণগুলির উচ্চারণ, সাধারণত স্বরধ্বনির উচ্চারণে অপিনিহিতির সংরক্ষণ ও অভিশ্র“তির অভাবÑএইগুলিকে আশ্রয় করিয়াই বিদ্যমান ছিল পশ্চিমবঙ্গের ও পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষার মুখ্য প্রভেদ।’
এ কথা সত্য পশ্চিমবঙ্গের ভাষা একদা পূর্ববঙ্গের ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তার অন্যতম প্রধান কারণ, কলকাতাকেন্দ্রিক রাজধানী জীবন। আজ বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে কলকাতার সেই একক আধিপত্য নেই। বরং ভাষা স্বাতন্ত্র্যের ক্ষেত্রে আশ্রিত ও মুখাপেক্ষী হয়ে উঠেছে। এমনকি এ ভাষার যথাযথ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের দিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে কিংবা হবে।
উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকেন্দ্রিক বাংলা গদ্যের যে সূচনা হয়েছিল, সে ভাষা আজ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছে। যার ছাঁদ ও ঠাঁট ইচ্ছে করলেই আমরা রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারি না। এদেশের বহু বাঙালি মুসলমানকে আক্ষেপ করতে শুনেছিÑ সুলতানি ও মোগল আমলে বাংলা ভাষা যে ধারায় বিকশিত হয়ে উঠছিল, ইংরেজ আমলে হিন্দু পণ্ডিতরা সে ভাষাকে কৌশলে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। আক্ষেপ ও অতীতমেহন বাঙালি মুসলিম চরিত্র ও চিন্তার মানসিক ব্যাকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অজ্ঞতা ও যুক্তিহীনতা তাকে পদে পদে মার খাওয়াচ্ছে। মুসলিম শাসনের ফলে বাংলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে মুসলমানদের দাবি আছে সত্য। কিন্তু এ ভাষাটি বিশেষ করে গদ্য বিকাশে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। অধিকাংশ সাধারণ মুসলমানের একমাত্র ভাষা বাংলা হলেও উচ্চ ও মধ্যবিত্তের যে শ্রেণীটি বাংলা ভাষা চর্চায় অবদান রাখার কথা, তাদের অধিকাংশেরই বিকল্প ভাষা থাকার কারণে পবিত্রতার সঙ্গে বাংলা তাদের মনে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। তবে বাংলা ভাষা যতই ম্লেচ্ছদের ভাষা হোক বাঙালি মুসলমানের প্রেম ও প্রার্থনার একমাত্র ভাষা এটি। আর সে ভাষাকে ধরে রাখতে ভাষা আন্দোলনের মতো একটি বড় ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। কিন্তু সে ভাষার বিরুদ্ধে কোনো নীরব চক্রান্ত হচ্ছে না সে কথা কিন্তু বলা যায় না। বহুজাতিক দেশ ও বহুজাতিক সংমিশ্রণে অনেক ভাষাই আজ মার খাচ্ছে। অনেক ভাষাই আজ নতুন রূপ গ্রহণ করছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় তামিল ও সিংহলিদের ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারা নিজের ভাষার চেয়ে ইংরেজিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার ভারতেও নিজভাষার সঙ্গে ইংরেজির মিশ্রণে এক নতুন ভাষার জন্ম নিচ্ছে। আমরা ভাষার সংরক্ষণ না উদারীকরণের পক্ষে এটি আজ একটি বড় প্রশ্ন। ভাষার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় দুটিই ক্ষতির কারণ। ইংরেজিকে আমরা আজ গ্রহণ করার কথা বলছি ঠিকই কিন্তু তা কেবল আমাদের কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার জন্য একটি ভিন্ন ভাষার মর্যাদা নিয়েছে। কিন্তু আমাদের নিজের ভাষার ভেতরে তাকে জায়গা করে দিতে থাকলে সে আবার দুর্বল শব্দ ও সিনট্যাক্সকে সরিয়ে দেবে না তা কিন্তু বলা যায় না। ভাষার চরিত্রও ভাষা ব্যবহারকারীদের মতো। ইংরেজরা যেমন প্রথমে ধর্মপ্রচারের অনুমতি নিয়ে রাজ্য শাসন করে গেছে। তেমনি ইংরেজি ভাষারও একটি সর্বগ্রাসী রূপ আছে- সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
পুঁথি থেকে, বাঙালি কৃষক জীবন থেকে, ঢাকাইয়া কুকনি থেকে নতুন গদ্যভাষা সৃষ্টির যে প্রয়াস চলছে আমরা তাকে অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে রেখেও বলতে পারিÑ সব ভাষারই একটি স্ট্যান্ডার্ড ফর্ম রয়েছে। ইংরেজি কিংবা ফারসী ভাষা লিখিত চারশত বছর আগের কোনো পুস্তক এবং ব্রিটেন বা আমেরিকার লেখকদের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা ভাষার নয়, জীবনযাপন ও সময়ের পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা মাত্র। কোনো আঞ্চলিক ভাষাকে যেমন বর্তমান লেখ্য ভাষার বিপরীতে দাঁড় করানো সম্ভব নয়, তেমনি ঢাকার নব বিকশিত কথ্যভাষাকে লেখ্য ভাষা করে তোলার যথেষ্ট সময় হয়নি।
পূর্বে উল্লিখিত সম্পাদকীয়র সূত্র ধরে আরো একবার বলতে চাইÑ আলালী কিংবা হুতুম পেঁচার ভাব ধইরা ইংরেজি মিক্সিং ভাষা নব্য উপনিবেশবাদের ইঙ্গিত নয় তো!

(Visited 20 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *