হেমন্তের ছোঁয়া

শেয়ার করুন

তারেক খানঃ শীতের পরশ আলতো করে গায়ে মাখিয়ে প্রকৃতি সেজেছে তার নিজের সাজে। বড় হচ্ছে রাত, দিন ছোট হচ্ছে। কমছে তাপমাত্রা। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো থাকে ভোরের প্রকৃতি। যতদূর চোখ যায় কেবল সাদা কুয়াশার মেলা ছারা আর কিছুই চোখে পড়ে না। মাঠের বিশাল প্রান্তর যেন কুয়াশার ধূম। শিশির ভেজা কোমল ঘাসের ওপর পা দিলে পায়ের তলা শিরশির করে ওঠে। তার ওপর দিয়ে খালি পায়ে কেবলই হাঁটতে ইচ্ছে করে।
গ্রামের পুকুরগুলো যেন মস্তবড় এক একটা ভাতের পাতিল। সেই পাতিল থেকে বলক দেয়া ভাতের মতন ধবধবে সাদা ভাপ উঠছে। দূরে দেখা যায় মাঠের এক প্রান্তে ঘন খেজুর বাগান। ইতিমধ্যেই গাছি গাছে ভাঁড় ঝুলিয়ে দিয়েছে। রাতভর সেই ভাঁড়ে জমা হবে খেজুরের রস। ভোর সকালে সেই রস যখন বাড়িতে আনা হবে তখন সমগ্র বাড়িটাই ভুরভুর গন্ধে ভরে উঠবে। শীতের সকালে নরম মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। বরই গাছগুলো ফুল আর কুঁড়িতে সেজে উঠছে নতুন সাজে। অর্থাৎ সামনেই পাকা বরই। ভাবতেই জিভে জল এসে যায়।


সময় গড়িয়ে যায়। এক সময় কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে পূবাকাশে, মাঠের শেষ প্রান্তে দেখা যায় ডগমগে লাল সূর্য। সূর্যের নরম রোদ গায়ে লাগতেই অন্যরকম শিহরণ জেগে ওঠে। বেলা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে কেটে যায় কুয়াশা। স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে মাঠের সবুজ ধানের ক্ষেত। ধানের ক্ষেতের ওপর দিয়ে ঝিরঝির বয়ে যায় বাতাস। হালকা বাতাসে দোল খায় ধানের শীষ। সেই বাতাস গায়ে লাগতেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। রোদে ঝিলিক দিয়ে ওঠে ঘাসের ডগায় জড়িয়ে থাকা রূপালি শিশির। চোখ ফেরানো যায় না সে দিক থেকে।


বেলা বাড়তে থাকে। চলে রৌদ্র-ছায়ার খেলা। চকমকে নীল আকাশে উড়ে যায় পেঁজাতুলোর মতো হালকা মেঘ। নরম রোদে জেগে ওঠে খাল, বিল, পুকুর, দিঘি। দিঘির বুকে চমৎকার রঙে ফোটে পদ্মফুল। বিল বাওড়েও পদ্মের পশরা। আর কলমি লতার বাহার। সে কী সুন্দর!
বাড়ির সামনে ছোট্ট ফুল বাগানে ফোটে কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, গাঁদা সেই সাথে আছে নাম না জানা কত রকমের মেঠো ফুল, বনফুল। ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয় চারিপাশ। তাইতো চারপাশে কত রঙিন প্রজাপতি! ডালিম গাছটিতেও  ডালে-ডালে ডালিম ফুলের রাঙা পাঁপড়ি। ঘন সবুজ মটরশুটি, খেঁসারি, মাশকালাই, সরিষা, পেঁয়াজ, রসূনের ক্ষেত আপন মনেই রঙ ছড়াচ্ছে। মাঠে-ঘাটে-গাছে, হাওড়-বাওড়, বিলে-ঝিলে, বন-বাদাড়ে ডানা মেলে বাবুই, শালিক, দোয়েল, ঘুঘু, অতিথি পাখি সহ কত যে পাখির কিচিরমিচির মধুর তান। তারা সরব করে তোলে পাড়া গ্রাম।
বিকেলে রোদের তেজ কমে আসে। পড়ন্ত বিকেলের রোদটা মায়া ধরিয়ে দেয়। গোধূলীর আকাশ যেন সবকিছু রঙিন করে তোলে। কোন দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। যেদিকেই তাকানো যায় প্রকৃতি মুগ্ধ করে তোলে। চারিদিকে সুন্দরের হাতছানি। রাতে হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো জোছনার আলোতে সবকিছু কেমন মায়াবি করে তোলে। দূরে শেয়ালের ডাকে সবকিছু কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে। 
চারিদিকে কত পরিবর্তন! আর এত পরিবর্তনের একটাই কারণ, আর সেটা হলো হেমন্ত। যা শীতের পূর্বাভাস।


হেমন্ত আসে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ- এ দুই মাস নিয়ে মজার ঋতু হেমন্ত। কার্তিক মাসটা প্রায় দখল করে রাখে শরৎ। কিন্তু অগ্রহায়ণ এলেই প্রকাশ পায় হেমন্তের আসল রূপ। তখন মাঠভরা পাকা ধান, ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠা, পায়েসের ধুম। তার মৌ-মৌ গন্ধের টান উপেক্ষা করতে পারে কে? হেমন্ত এদেশের মাটির সন্তানদের হাতে তুলে দেয় শস্য সম্পদের ভান্ডার। ঘরে-ঘরে সোনার ফসল ওঠে। কৃষকের বহু কাক্সিক্ষত স্বর্ণালি ধান উপহার দেয় হেমন্ত। পাকাধানের গন্ধে আমোদিত হয় চারিদিক। বাড়ির আঙিনা মুখরিত হয় ঢেঁকির সুমধুর তালে তালে। বাংলার গ্রামগুলো নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। কৃষকের চোখে জাগে নতুন স্বপ্ন।


হেমন্ততো এমনি। এমনি মন মাতানো সবুজ সুন্দর এই বাংলার বৈচিত্র্যে ভরপুর এক আশ্চর্য সুন্দর ঋতু হেমস্ত।

(Visited 3 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *