একটি গুলি – সমীর আহমেদ

শেয়ার করুন

লোকটির নাম তাজুল ইসলাম। বয়স আটষট্টি বছর। মাথায় চুল খুব অল্প। সবই শাদা। তার রিপোর্ট দেখে আতকে উঠলেন আহমেদ কবীর। তার বুকের ভেতর আঁটকে আছে আস্ত একটা বুলেট! বহু দিনের পুরনো। যে কোনো সময় হার্টের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দিতে পারে বুলেটটা। এমন একটা মারাত্মক বুলেট নিয়ে সে এতদিন বেঁচে আছে কীভাবে? ভাল করে তাকালেন তার দিকে। চেহারা-সুরত নিপাট ভদ্রলোকের মতো। পরিচ্ছন্ন। মুখে আধাপাকা, কাটছাঁট সুন্দর দাঁড়ি-গোফ। চেহারা শান্ত, গম্ভীর। এরকম ঠান্ডা মাথার মানুষগুলোই তো… না না, এ লোকটিকে বাজে কিছুই ভাবা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বুকের ব্যথায় কেমন কাতরাচ্ছে! সঙ্গে তার স্ত্রী। চেহারা গোলগাল। বুড়িয়ে গেলেও এখনও তার ত্বক বেশ উজ্জ্বল। মাথার চুল অল্পই পেকেছে তার। দায়িত্বশীল স্ত্রীই মনে হচ্ছে তাকে। স্বামীর জন্য কেমন মুষড়ে পড়েছে সে। চোখে-মুখে ঝুলে আছে একরাশ উদ্বিগ্নতা। আহমেদ কবীরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে অস্ফুটে সে উচ্চারণ করলো, ডক্টর সাহেব!
আহমেদ কবীর তাকালেন তার দিকে।
কিছু একটা করেন। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।
হুম, কষ্ট তো হবেই। বুকের ভেতর আস্ত একটা বুলেট!
তারা কেউই চমকালেন না। তাজুল ইসলাম বললেন, জানি, ডাক্তার সাহেব।
জানেন?
জানবো না!
তার ব্যথা বোধ হয় কিছুটা কমে এসেছে। ঠোঁটে এক ঝলক রহস্যময় হাসি খেলেছে এখন। সেদিকে তাকিয়ে আহমেদ কবীর বললেন, ওহ্। তা তো জানারই কথা। গুলিটা যেভাবে বুকের ভেতর বসে আছে, তা দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন আগের।
হ্যাঁ, ডাক্তার সাহেব। আগের তো বটেই! আটষট্টি বছর আগের।
আটষট্টি বছর আগের! বলেন কী! বুকের ভেতর কীভাবে ঢুকে পড়লো গুলিটা? সে কথা না-ই বা জানলেন, ডাক্তার সাহেব। জেনে আর কী হবে!
আহমেদ কবীর ভাবলেন, এমন কোনো ঘটনা জড়িয়ে আছে এ বুলেটের সাথে, যা লোকটি বলতে চাচ্ছে না। অস্বস্তিবোধ করছে। তাকে আর ঘাটানোর দরকার নেই। সে যে-ই হোক, রোগী তো! ডাক্তারের ধর্ম সেবা করা। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বর্জন করাই উচিত এখন।
এতদিন আগের বুলেট! ব্যথা হত না?
ব্যথা হত মাঝে মাঝে। তবে তা খুবই সামান্য। আমি মোটেও আমল দিতাম না। কিন্তু ইদানিং ব্যথাটা খুব বেড়ে গেছে।
ওটা আপনার হার্টকে রক্ত সঞ্চালনে বাধা দিচ্ছে। হৃদয়ের গভীরে আরেকটু গেলে ওটা আপনার হার্টকে যে কোনো মুহূর্তে বিকল করে দিবে।
তাহলে?
বুলেটটা ফেলে দিতে হবে।
ফেলে দিতে হবে! না ফেললে হয় না ডাক্তার সাহেব?
আহমেদ কবীর তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে।
অপারেশন ভয় পান?
না।
তাহলে? আর্থিক সংকট?
না, সে সামর্থ আল্লাহপাক আমাকে দিয়েছেন।
তাহলে?
তাজুল ইসলাম চুপ করে রইলেন। আহমেদ কবীর বললেন, একটা বুলেটের জন্য এত মায়া! আশ্চর্য। কেন?
আপনি বুঝবেন না ডাক্তার সাহেব। কিংবা আমিই আপনকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না।
তাই! কিন্তু ওটাকে ফেলে দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ডাক্তার সাহেব এমন কিছু করা যায় না Ñ বুলেটটাকে ফেলে না দিয়ে…।
দেখুন যৌবনের অনেক গোয়ার্তুমি শরীর সয়ে নেয়। কিন্তু এখন আপনার বয়স হয়েছে। ডায়াবেটিস আছে। এ ধরনের ঝুঁকি নিবেন না। ওটাকে ফেলে দিতেই হবে। যদি বেঁচে থাকতে চানÑ এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তাজুল ইসলামের মুখ থমথমে, গম্ভীর। তার স্ত্রী বললেন, আমি তোমার আর কোনো কথা শুনতে চাই না। এবার এই আপদ ফেলে দাও। উহ! কদিন ধরে কী কষ্টই না পাচ্ছো! আমি আর সইতে পারছি না। ডাক্তার সাহেব আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন। আজই।
আর দু একদিন না হয় দেখি। ব্যথানাশক ঔষধ খেলে…
ও সব তো খাচ্ছোই। কাজ হচ্ছে?
তাজুল ইসলাম চুপ করে রইলেন। ডাক্তার আহমেদ কবীর কিছুতেই বুঝতে পারছেন নাÑ অপারেশনে যার ভয় নেই, আর্থিক দৈন্য যার নেই, সে কেন এমন একটি আস্ত বুলেট বুকের ভেতর পুষে রাখছে, তাও এক দুই বছর নয়Ñ আটষট্টি বছর! আর এখন এত যন্ত্রণার পরও, মৃত্যু ঝুঁকির কথা জানার পরও বুলেটটা ফেলে দিতে রাজি হচ্ছে না। আটষট্টি বছর! তার মানে কী দাঁড়ায়? কত সালের ঘটনা এটা? এখন তো দুই হাজার সতেরো। আটষট্টি বছর আগের ঘটনা। তার মানে কত সাল? ১৯৫২! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সেই সময় আপনি কোথায় ছিলেন? কীভাবে লেগে ছিল গুলিটা?
তাজুল ইসলাম চুপ করে রইলেন। তার স্ত্রী বললেন, মিছিলে ছিল, ডাক্তার সাহেব। ভাষার জন্য রাজপথে নেমেছিল।
আহ! চুপ কর।
না, আমি আর চুপ করে থাকতে চাই না। সত্যিটা জানুক সবাই।
সত্যিটা কী? কেন গোপন করছেন?
ডাক্তার সাহেব, সবাই জানে ও মারা গেছে। শহিদ হয়েছে।
আশ্চর্য!
হ্যা, ডাক্তার সাহেব। কিন্তু আমি তো মারা যাইনি। শহিদ হতে পারিনি ডাক্তার সাহেব। এই লজ্জায়…।
তাতে কি, আপনি তো ভাষা আন্দোলনের মিছিলে ছিলেন। সেখানেই গুলি খেয়েছেন। ফেব্র“য়ারির ২১ তারিখে, তাই না?
হ্যা, ডাক্তার সাহেব?
সব কিছু মনে আছে আপনার? সেসব কথা কি ভুলা যায়, ডাক্তার সাহেব? সকাল এগারটার দিকে আমরা মধুর ক্যান্টিনে জড়ো হয়েছিলাম। সালাম, বরকত, রফিক, শফিউল, জব্বার সবাই ছিল। ইপিআর মিছিল বের করতে নিষেধ করছিল। আমরা শুনি নি। মিছিল নিয়ে আমরা ঢাকা মেডিক্যালের খেলার মাঠের দিকে এগিয়ে যাই। আমাদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করি, এক পুলিশ সদস্য রাইফেলে গুলি ভরছে। আমি আমার আশপাশের সবাইকে সতর্ক করে দেই Ñঅবস্থা ভাল নয়। এক্ষণি এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। তার পর যে যার মতো ছুটতে থাকি। হঠাৎ আমার পেছনে কিসের যেন আঘাত লাগে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি একটি ড্রেনে পড়ে যাই। পিঠে হাত দিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। বন্ধ হচ্ছে না। বুঝতে পারি, গুলি লেগেছে পিঠে। চিৎকার দেই Ñতোরা কোথায়? আমার পিঠে গুলি লেগেছে। সবাই ছুটে এসে আমাকে ড্রেন থেকে তোলে। তারপর একটা রিকশায় তুলে নিয়ে যেতে চায় মিটফোর্ড হাসপাতালে। বাধা দেয় একজন Ñ ওদিকে যাওয়া যাবে না।
তারপর?
ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায় আমাকে। তাড়তাড়ি একটা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। জার্মানির ডাক্তার নোভাকের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। এক্সরে করে দেখলেন, ভেতরে গুলি। কিন্তু সেই সময় অপারেশন করার মত অবস্থা ছিল না। পুলিশ লাশ খুঁজছে। লাশ পেলেই রাতের আঁধারে সরিয়ে ফেলছে। তিন চার দিন পর এক নার্স এসে বললো, অবস্থা খুব খারাপ। পুলিশ আন্দোলনকারীদের খুঁজছে। তুমি যদি বাঁচতে চাও, তাহলে এক্ষণি পালাও।
তারপর হাতপাতাল থেকে পালিয়ে গেলেন?
হ্যা।
কিন্তু আপনার শহিদ হওয়ার রটনাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসার পর আমি আর কারো সাথে যোগাযোগ রাখিনি। আমাকে না পেয়ে সবাই মনে করেছে Ñ আমি মারা গেছি। আমার লাশ পুলিশ রাতের আঁধারে কোথাও পুঁতে রেখেছে।
হাউ স্ট্রেঞ্জ ইট ইজ!
হ্যা। বেগম তাজুল বললেন, তাকে নিয়ে তো মহাদেব সাহা কবিতাও লিখেছেন Ñএকুশের গান। শুনেন নি আপনি? ওই যে…একুশ মানেই ফিরে আসছে সালাম, ফিরে আসছে বরকত, ফিরে আসছে তাজুল ফিরে আসছে…
তাই! কী লজ্জাকর! জানতাম না। আসলে ডাক্তারি করতে করতে সাহিত্যের দিকে নজর দেয়া হয় না। সারাদিন হাসপাতাল, রোগী, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপারেশন থিয়েটার এসব করতে করতেই সময় যায়। যাক সে কথা, আপনি জানান নি কেন Ñ আপনি বেঁচে আছেন?
আমি জানতাম না ডাক্তার সাহেব। ক্ষতটা শুকানোর কিছুদিন পরই আমি বাইরে চলে যাই। অনেকদিন পর আমি জানতে পারি Ñ আমার নাম ভাষা শহিদদের তালিকায়। তারপরই ভীষণ লজ্জা হয় Ñ কেন যে সেদিন মরে গেলাম না। তাহলে কত ভাল হত।
তাতে কী! আপনার গৌরব তো কোনো অংশে কমেনি। সত্যি আপনাকে দেখে খুব ভাল লাগছে আমার। খুব আনন্দ হচ্ছে। এবার অপারেশনটা করে গুলিটা বের করে আপনাকে সুস্থ করে তুলতে পারলে আরও ভাল লাগবে।
গুলি! এটা আমার আটষট্টি বছরের স্মৃতি, ডাক্তার সাহেব। ফেলতে ইচ্ছে করে না। ব্যথা হলেও মন চায় Ñ ওটা ওখানেই থাক। হৃদয়ের খুব গভীরে…
কিন্তু ওটা বুলেট! পাকিস্তানি ঘাতক বুলেট!
জানি, কিন্তু মৃত। এর সাথে জড়িয়ে আছে, সেই সব উত্তাল দিন। বজ্রবর্ষি শ্লোগান Ñ রাষ্ট্রভাষা, বাংলা চাই…। শরীরের রক্ত এখনও টগবগ করে ওঠে, ডাক্তার সাহেব। মনে পড়ে সালাম, বরকত, শফিউর… আরও কতজনের উত্তপ্ত মুখ! মনে হয় আমার ভেতরে শুয়ে আছে রক্তাক্ত বর্ণমালা Ñ অ আ ক খ…বিশ্বাস করুন, আমি বার বার সেসব দিনে ফিরে যাই। আর কিছুটা হলেও সুখ পাই, শান্তি পাই, এটা ভেবে যে, আমিও সেদিন তাদের সাথে ছিলাম। কিন্তু দুঃখ হয় আমি এখনও বেঁচে আছি। সেদিন গুলি লাগার পরও তাদের সাথে মরে যেতে পারিনি। দেখুন, একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার সেসব দিন এখন ইতিহাস। ইতিহাস আপনি নিজেও। মাঝখানে শুয়ে আছে একটি ঘাতক বুলেট Ñ শক্র। শক্র মৃত হলেও তাকে বয়ে বেড়াতে নেই Ñ মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে।
ডাক্তার সাহেব! কাঁটা খুলে ফেললে কাঁটা থাকে না। কিন্তু ক্ষত তো থাকে, থাকে না?
আহমেদ কবীর তাকালেন, তাজুল ইসলামের দিকে। বাঁ হাতটা বুকের ওপর চেপে ধরে বসে আছে সে। যন্ত্রণায় ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছে। বেগম তাজুল বললেন, ডাক্তার সাহেব! ও যেন কেমন করছে। যা করবার তাড়াতাড়ি করুন।
আহমেদ কবীর ডাকলেন, সিস্টার, সিস্টার। একটা স্ট্রেচার, তাড়াতাড়ি…।

(Visited 3 times, 1 visits today)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *